একদিন নেমেছিল তীব্র ঢল। পরের দু’দিন ঢল নামার গতি কম ছিল। এই তিন দিনে সিলেটে হঠাৎ বিপর্যয় দেখা দেয়। পানিতে সয়লাব হয়ে পড়ে সিলেট। আর এতেই ক্ষতি প্রায় ৪৮০ কোটি টাকার। বেশি ক্ষতি হয়েছে সড়কে। কৃষি খাতেও ক্ষতির পরিমাণ বেশি। ইতিমধ্যে দাপ্তরিক ভাবে এসব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। এখনো আশঙ্কা কাটেনি। বর্ষার মৌসুম পুরোটাই পড়ে আছে।
উজানে বৃষ্টি হলে আরও ঢল নামার আশঙ্কা আছে। আর ঢল নামলেই ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এবারের ঢলে সিলেট সিটি করপোরেশনে সড়কে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া, এলজিইডি’র আওতাধীন সড়কে ১শ’ ১৮ কোটি, সওজের আওতাধীন সড়কে ৮৪ কোটি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০ কোটি, কৃষি বিভাগের ১৪২ কোটি ও মৎস্যখাতে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন- বন্যার পানি উঠে যাওয়ার কারণে সিলেট সিটি করপোরেশনের নদী তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় পানি উঠে যায়। এতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নগরের উপশহর এলাকা। বর্ষা মৌসুমের আগে উপশহরের সড়কগুলোতে কাজ করানো হয়েছিল। কাজ করার কিছুদিনের মধ্যে বন্যার পানি আঘাত হানে। এ ছাড়া অতিবৃষ্টির কারণে নগরের চৌহাট্টা সহ কয়েকটি এলাকার সড়কের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন- সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। এসব সড়ক হয়তো বর্ষার মৌসুম শেষ হলে ফের মেরামত করার প্রয়োজন হবে বলে জানান তিনি। সিলেট জেলার ১৩টির মধ্যে ১২টি উপজেলাই বন্যাকবলিত হয়েছে। বর্তমানে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। বন্যার ভয়াবহ অবস্থা ছিল গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায়। এই ৫টি উপজেলার সড়কে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। উপজেলাগুলোর প্রধান প্রধান সড়ক শুরুতেই তলিয়ে যায়। অনেক সড়কে কয়েকদিন যান চলাচল বন্ধ ছিল। পানির কারণে যতটা না বেশি ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে উজানের ঢলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোয়াইনঘাটে সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে গোয়াইনঘাট-সোনারহাট সড়ক ঢলের তোড়ে বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে। জেলায় এলজিইডি’র আওতাধীন প্রায় ১৬০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতি হওয়ার হিসাব প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১শ’ ১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কেএম ফারুক হোসাইন। তিনি জানান- গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে সবচেয়ে বেশি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য আপাতত সড়কগুলোতে কিছু সংস্কার হবে। পরবর্তীতে এগুলোর তালিকা ঢাকায় পাঠানো হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগ-সওজ’র আওতাধীন প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৮৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখনো কয়েকটি সড়কে পানি রয়েছে। চূড়ান্ত সমীক্ষায় এ ব্যয় বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির হোসেন। সিলেটে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে; সারি-গোয়াইনঘাট সড়ক, দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক, কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়ক, ফেঞ্চুগঞ্জ-মানিকোনা সড়ক। এ ছাড়া জৈন্তাপুরে সিলেট-তামাবিল সড়কেও এবারে বন্যার পানি উঠে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, সিলেট জেলার জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ সহ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। বহু স্থানে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে। আবার কিছু কিছু এলাকায় বাঁধ উপচেও পানি ঢুকেছিল। এতে এসব বাঁধে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ হিসাব প্রাথমিক ধারণার। পানি নেমে গেলে চূড়ান্ত সমীক্ষা করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। সিলেট জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল খায়ের মো. মোল্লা জানিয়েছেন- এবারে বন্যায় সিলেট জেলায় কৃষিখাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৪২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার। বিশেষ করে আউশ ধান, আউশের বীজতলা ও গ্রীষ্মকালীন সবজিতে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৪৩ হেক্টর। এবারের বন্যায় সিলেটের মৎস্যখাতে ২০ কোটি ৬১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বে থাকা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সীমা রানী বিশ্বাস। তিনি জানিয়েছেন- বন্যায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার মৎস্য খামারের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এদিকে- নগরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও জেলার কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় পানি এখনো রয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে- এখনো ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। জেলার ১২টি উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়নের ৮১২টি গ্রাম এবারের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।