ধরে নেওয়া হয়– পুলিশে যারা চাকরি করেন, তারা মানসিকভাবে শক্ত। যোগদানের আগে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। কর্মজীবনেও থাকে বিপদ, চাপসহ নানামুখী ঝুঁকি। অনেকে আবার পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। নিত্য সামলাতে হয় সমাজের নানা অবক্ষয় ও অস্থিরতার ঢেউ।
মানুষ হিসেবে এসব স্পর্শ করলেও কর্মরত অবস্থায় তাদের মানসিক গঠনে পরিবর্তন আসছে কিনা তা জানার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই পুলিশে। এমনকি কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজি ইউনিটও নেই। ফলে প্রায়ই পুলিশ সদস্যদের আত্মহনন, অন্যকে গুলিসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা সামনে আসে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে কনস্টেবল কাওছার আলী খুব কাছে থেকে গুলি করে সহকর্মী মনিরুল হককে হত্যা করেন। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর কাওছারের পরিবার জানায়, মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন কাওছার। পাবনার মানসিক হাসপাতালে একাধিকবার চিকিৎসাও নিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে পেশাগত কাউন্সেলিং ভালো ভূমিকা রাখে। পুলিশের মতো পেশাজীবীদের কাজের ফাঁকে গান শোনা জরুরি। মানসিক প্রশান্তির জন্যই বিভিন্ন পেশার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান এবং মাঝেমধ্যে ছুটি নিয়ে ঘুরতে যাওয়া দরকার। কাউন্সেলিংয়ের জন্য পুলিশে সাইকোলজি ইউনিট গঠনেও জোর দেন তারা। এমনকি পুলিশে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে পিএইচডি অধ্যয়নরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, পুলিশিং সবসময় চ্যালেঞ্জিং কাজ। অথচ সদস্যদের মানসিক স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের কোনো ব্যবস্থা বাংলাদেশ পুলিশে নেই। মানসিক কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও নেই। তিনি বলেন, শিকাগোতে দেখছি– পুলিশ অন্যান্য সংস্থার মধ্যে যৌথভাবে মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করে। পুলিশে নানা স্ট্রেস থাকে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হঠাৎ যে কেউ ট্রমায় পড়তে পারেন। সে সময় মানসিক সুরক্ষা না পেলে তার পক্ষে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, পুলিশে যোগদানের আগে যে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়, তা যেন নামকাওয়াস্তে না হয়। চাকরিকালীনও সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় সার্বক্ষণিক দেখভালে সাইকোলজি ইউনিট দরকার। বাহিনীর সদস্যদের আচরণগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে কিনা, তা কর্তৃপক্ষ দেখবে। এ ধরনের কিছু নজরে এলে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খন্দকার মহিদউদ্দিন বলেন, পুলিশে মানসিক কাউন্সেলিং স্বতন্ত্র ইউনিট দরকার। উন্নত বিশ্বে পুলিশ বাহিনীতে এমন ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের এখানেও পুলিশ সদস্যদের ব্রিফিং নেওয়ার সময় কারও কারও এমন সমস্যা সামনে এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২০২০ সালে কনস্টেবলদের সমস্যা নিয়ে জরিপ চালায় পুলিশ সদরদপ্তর। সেখানে উঠে আসে, ২৩ দশমিক ০৮ শতাংশ কনস্টেবল সময়মতো ছুটি না পাওয়াকে পেশার বড় সমস্যা মনে করেন। উপপরিদর্শকদের (এসআই) ক্ষেত্রে এ হার ২১ দশমিক ২২। ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ কনস্টেবল পরিবারকে সময় দিতে পারেন না বলে মতামত দেন। থানায় রাজনৈতিক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাজে ব্যবহারকে সমস্যা বলেছেন ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। আরআইকে ঘুষ না দিলে ছুটি হয় না বলে অভিযোগ করেন ২৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর জরিপে অংশ নেওয়া শতভাগ পুলিশের ভাষ্য ছিল, কর্মঘণ্টা ৮ হওয়া উচিত।
পুলিশে বছরে ২০ দিন সাধারণ (ক্যাজুয়াল লিভ) ও ৩৫ দিন অর্জিত ছুটি (আর্ন লিভ) রয়েছে। ১৫ দিনের ‘রেস্ট অ্যান্ড রিক্রিয়েশন লিভ’ মেলে তিন বছর পরপর। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, অতিরিক্ত ডিউটি, ছুটি ও পদোন্নতি না হওয়া এবং দীর্ঘদিন কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়নের কারণে সদস্যদের একটি অংশ হতাশায় ভুগছেন।
পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার অন্তত তিন সদস্য বলেছেন, ট্রাফিক পুলিশে কর্মরতদের নানা রোগব্যাধি দেখা দেয়। গরম ও বৃষ্টিতে ভিজে তারা দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি ধুলাবালি ও শব্দদূষণে তাদের শারীরিক ক্ষতি হয়। এ ছাড়া থানায় কর্মরতদের প্রতিদিন অনেক কল ধরতে হয়। কথাবার্তার সময় কেউ কেউ মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না। দিনশেষে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্যদের ওপর।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘পুলিশ স্ট্রেস’ বিশেষজ্ঞ জন ভিওলান্টি। নিউইয়র্ক স্টেট পুলিশে ২৩ বছর চাকরি করার পর এখন তিনি পুলিশ সদস্যদের মানসিক চাপের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘পুলিশ সুইসাইড’ বই। ২০১২ সালে পুলিশের সমসাময়িক চাপ ও ঝুঁকির বিষয়ে দু’জন সহকর্মীর সঙ্গে জন ভিওলান্টির একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। পুলিশিং পেশার স্ট্রেসের কারণ হিসেবে তাতে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংস ঘটনা, ট্রমা বা মানসিক আঘাতের প্রকাশ, বিরক্তিকর সময়সীমা, অসংগত শিফট ও দুশ্চিন্তাকে উল্লেখ করা হয়।
মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে পুলিশ সদস্যদের আত্মহত্যার পেছনে জন ভিওলান্টি ১০টি বিষয় চিহ্নিত করেন। তা হলো– পেশাগত ব্যস্ততার কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমস্যা ও বৈবাহিক জীবনে টানাপোড়েন, আইনি ঝামেলা, অভ্যন্তরীণ তদন্ত, হতাশায় মাদক সেবন, পেশাগত বিষণ্নতা, আঘাতমূলক ঘটনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাপ্যতা, মানসিক সহায়তার অভাব, মানসিক সহযোগিতা চাওয়ার ভয় ও মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রতি অবিশ্বাস।