মৌ পোকার দল এক বিন্দু মধু সংগ্রহের জন্য অনুক্ষণ শত মাইল বেগে কাছে দূরে ছুটে বেড়ায় হাজারো ফুল, ফলমূলে। বিন্দু বিন্দু মধু আহরণ করে মৌ পোকারা এক সময় চাক পূর্ণ করে। এমন কষ্টকর অন্বেষণে মৌচাক পূর্ণ হলে এক সময় মৌয়ালি চাক কেটে মধু নিয়ে ঘরে ফেরে। মৌয়ালি কেবল তখন বুঝতে পারে কি পরিমাণ মধু সে বিনা পরিশ্রমেই সংগ্রহ করে নিলো। মৌ পোকারা কখনোই জানতে পারে না, কতটা মধু ওদের কাছ থেকে মৌয়ালি নিয়ে যায়। এই পরিমাণ মধু সংগ্রহ করতে মৌ পোকাদের কত শত কোটিবার তাদের ডানা মেলতে আর বন্ধ করতে হয়েছে আর সেটি কতটা শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এমন বোধ মৌ পোকাদের না থাকারই কথা। ঝড় বাদল ঝঞ্ঝা সব প্রতিকূলতার মধ্যেই মৌ পোকার দল বিরামহীনভাবে বিন্দু বিন্দু করে সিন্ধুর মতো ফুলের নির্যাসে টইটম্বুর করে তোলে মৌচাক। মৌ পোকাদের নিয়তি এমনই, কষ্টের মৌচাক ভেঙে নেয় মৌয়ালি। এমন বঞ্চনার পরও মৌ পোকাদের ক্লান্তি নেই। তারা আবারো মৌচাক গড়ে।
মৌ পোকাদের মতোই এই জনপদের মানুষের ভাগ্য কি প্রায় অভিন্ন হয়ে ওঠেনি। এ রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক মোক্তার ১৮ কোটি মানুষের এভাবে বঞ্চিত হওয়ার বোধ কখনোই তাদের থাকার কথা নয়। মৌ পোকাদের মতোই কি এই জনপদের মানুষের ভাগ্য? তারা জানে না বা জানার কখনো সুযোগ হয়নি অথবা জানতে দেয়া হয়নি, দেশে কত সম্পদ তৈরি করেছে ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাত। তাদের পরিশ্রমজনিত মাথার কত ঘাম এ মাটিতে মিশে আছে। অবশেষে তারা ঠিকই জানলো, যখন তাদের সব সম্পদ তস্কররা মৌয়ালির মতো লোপাট করে নিয়ে গেছে। ছোট-বড়-মাঝারি সব ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন শূন্য, তখন টের পেল মানুষের গচ্ছিত লাখ লাখ কোটি টাকা খেয়ানত করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে একটা কথা প্রচলিত আছে ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’। এর মমার্থ হচ্ছে, রক্ষকেরই ভক্ষকে পরিণত হওয়া। দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যাকে কবির ভাষায় বলতে হয়, ‘একে একে শুখাইছে ফুল এবে/ নিবিছে দেউটি।’ এর ব্যাখ্যা এমন, সব আশা-ভরসার আলো একে একে নিভে যাচ্ছে। আঁধারে মিশে যাচ্ছে সব। এতদিন অর্থকড়ি লোপাট নিয়ে একটা আন্দাজ অনুমান ছিল। সর্বত্রই একটা আবরণ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। এখন ঘরে-বাইরে সবাই জানল অপরিসীম পরিশ্রম করে কী বিপুল অর্থের ভাণ্ডার গড়েছিল দেশের আধপেটে বা কখনো খালি পেটে থাকা হাড়সর্বস্ব মানুষগুলো।
সেই ধনভাণ্ডার যারা দেখভালের দায়িত্বে ছিল তাদের যোগসাজশেই দিবালোকে লোপাট হলো সব কিছু। কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করল না। ওই সব অবিশ্বস্ত ব্যক্তিরা জেগেই ঘুমিয়েছিল বা ঘুমের ভান করেছিল। সেসব পাইক পেয়াদার দল মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিনা দ্বিধায়। কেউ কেউ মনে করে, আসলে ওরা এ অর্থ লোপাট করেনি। তাদের ভেট দেয়া হয়েছিল। সেটিই তারা গ্রহণ করেছে। যেমন কাজের বিনিময়ে খাদ্য দেয়া হয়। তেমনি কাজের শেষে মজুরি দেয়া হয়েছে। যারা কাজ করিয়েছে তারা নিজের পকেট থেকে নয়, রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে সে অর্থ দিয়েছে। মনে হয় রাষ্ট্রের টাকা আর ব্যক্তির অর্থ এখন একাকার হয়ে গেছে। যেমন- দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, যখন কোনো জলস্রোত বিপুল বেগে বাঁধ ভেঙে সব সয়লাব করে দেয়, ঠিক তেমনি এ দেশের অর্থকড়ি স্রোতস্বিনী নদীর মতো দু’কূল ছাপিয়ে বেরিয়ে গেছে।
খুব মশহুর একটা কথা আছে। সেটা হলো, কারো অর্থসম্পদ খোয়া গেলে তার ক্ষতি হয় বটে; তবে কিভাবে, কোন কারণে অর্থসম্পদের ক্ষতি হলো তা খুঁজে বের করতে পারলে এক সময় তার প্রতিকার হতে পারে এবং ভবিষ্যতে এমন বিপদ আবারও হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। কারো স্বাস্থ্যের হানি ঘটলে সেটাও ওষুধপথ্যের সঠিক ব্যবহারে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কিন্তু কারো যদি চরিত্র ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার প্রতিকারের কোনো পথ থাকে না। চরিত্রের খুব স্পর্শকাতর বৈশিষ্ট্যগুলো বিলীন হয়ে গেলে সেটা দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরায় শিরায় শিকড় গাড়ে। প্রতি মুহূর্তে সেখান থেকে বিচ্ছুরিত হয় নানান অপকর্ম করার যত ভাবনা। তখন নিয়মনীতির সব শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। দুর্নীতি দুরাচার ভ্রষ্টচারের সব রাজপথ গলিপথ খুলে যায়। তখন সাহস নয় দুঃসাহস জন্মায়। ধরাকে সরাজ্ঞান করা হয়। চোখের পর্দা উঠে যায়। লোক-লজ্জা ভয়ভীতি সব দূরে সরে যেতে থাকে। সে সময় ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো চেতনাই আর কাজ করে না। ঘোড়া ছুটিয়ে চলার মতোই পতন গতি লাভ করে। সম্মুখে যাই ভেসে ওঠে সেটাই পাওয়ার আকাক্সক্ষায় হিতাহিত জ্ঞানটুকু পর্যন্ত আর থাকে না। বিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক নিও টলস্টয়ের সাড়া জাগানো একটা গল্প আছে। সেটা অনেকেরই জানা। সেই গল্পের নাম ‘একটা মানুষের কতটা জমি দরকার’। সে গল্প টলস্টয় ১৮৮৬ সালে লিখেছিলেন। সে গল্পের মর্মবাণী এখানে অনেকটা প্রাসঙ্গিক হবে বলে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- সে গল্পের নায়ক পাহোম। জমি জিরাতের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড লালসা। তার লালসা আশপাশের কৃষকদের প্রচুর কষ্ট দিত। জমি পাওয়া নিয়ে সে ছিল বুভুক্ষু। যখন যেখানে জমির খোঁজ পেত তা কেনার জন্য ছুটত। একদিন তার গোচরে এলো দূরের এক ভূস্বামী কম মূল্যে জমি বিক্রি করছে। পাহোম ছুটল সেখানে। সেই ভূস্বামী পাহোমকে জানাল, এক দিনে সে যত দূর হেঁটে যেতে পারবে, ততটা জমিই পাবে। তবে শর্ত থাকল, সূর্যাস্তের আগেই এখানে ফিরে আসতে হবে। সে যাত্রা শুরু করল। সম্মুখে যাই দেখে সেটাই তার পেতে হবে। এমন বাসনায় সে দ্রুত ছুটতে থাকল। হঠাৎ সম্বিত ফিরলে, দেখল সূর্যাস্তের আর বেশি সময় নেই। তখন ফেরার জন্য দৌড়াতে লাগল। কিন্তু অবশিষ্ট পথটুকু কম। বেলা ডোবার সময়ও আসন্ন। সে আরো দ্রুত দৌড়াতে থাকে। ক্লান্ত শরীর, সেই সাথে প্রবল উত্তেজনা। বেলাও ডুবল, পরিশ্রান্ত পাহোম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেখানে মারা গেল। তখন তার কবরের জন্য প্রয়োজন হলো মাত্র ৬ ফুট জমি।
আসলে লোভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। বাংলাদেশে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি এখন ঘটছে না?
যাক, রাষ্ট্রীয় স্তম্ভগুলোর পতনের ফল কতটা কি, এখন সেটা কম বেশি সবাই আঁচ করতে পারছে। বস্তুত এমন পরিস্থিতির কারণে রাষ্ট্রের জবাবদিহির যতগুলো ঘাট ছিল সব বিনাশ হয়ে গেছে। জবাবদিহির স্বাভাবিক যে সংস্কৃতি সেটা উধাও হয়ে গেছে। সে কারণেই বেনজীর আর আজিজদের আবির্ভাব আর উত্থান। কর্তাকে সেবা দিয়ে এরা কাজের বিনিময়ে নানা রসদ সম্ভার পেয়েছে এবং পকেট বোঝাই করেছে। আরো নাম ধাম ওই তালিকায় যোগ হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর পরও কথা থাকে। ধর্মের কল কিন্তু নাকি বাতাসে নড়ে। সবার অজান্তে সেই কল এখন বাতাসে নড়তে শুরু করেছে। যে কল দক্ষিণা বাতাসে, না বাউলা বাতাসে নড়ছে, অনেকই ঠাওর করতে পারছেন না। তবে বিজ্ঞজনদের এমনই বোধ, বাউলা বাতাসেই ধর্মের কল নড়ছে। বাউলা বাতাসে। এ বাতাস অনেকটা বুমেরাং মতোই হয়। উত্তর থেকে দক্ষিণে মুহূর্তে আবার দক্ষিণ থেকে হঠাৎ করে উত্তরে ফিরতে থাকে। যেন শাখের করাতের মতো। যেতেও কাটে আসতেও কাটে।
ndigantababar@gmail.com