আগামী বছরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সংস্থাটি বলেছে, এ সময়ে বাজেটে প্রক্ষেপিত মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একই সাথে সম্ভব নয়, প্রাক্কলিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ। সানেমের পক্ষ থেকে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাবকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে এবং কোনোভাবে এ সুযোগ দেয়া উচিত নয় বলে সংস্থা মনে করে।
জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ জানাতে গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টার ইনে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে সংবাদ সম্মেলনে সানেমের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা। সভাপতিত্ব করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান।
ড. সেলিম রায়হান মূল্যস্ফীতি না কমার কারণ সম্পর্কে তার মন্তব্যে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচলিত যেই পদ্ধতি অর্থাৎ মুদ্রানীতি, সেটি মূল্যস্ফীতি কমাতে সম্পূর্ণ কার্যকর হচ্ছে না। যে মুহূর্তে উপলব্ধি হল যে নির্দিষ্ট সুদের হার অর্থাৎ ৬-৯ নীতি কার্যকর নয় তখন চেষ্টা করা হলো বাজারভিত্তিক সুদের হার নেয়ার। তার পরও এই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না কেন? এটির একটি কারণ হচ্ছে নীতিটি অনেক বেশি দেরি করে নেয়া হয়েছে। সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের মূল কারণ হলো সার্বিক চাহিদা কমিয়ে আনা। তবে দেরি করে নীতি নেয়ার কারণ তা অনেকটা কমে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে আরো বেশি সুদের হারের পরিবর্তন করলে আর্থিক খাতে ধস নামবে। সুতরাং সঠিক সময়ে নীতি না নেয়ায় এই সুদের হার বাড়ানো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।
দ্বিতীয় জায়গাটি হচ্ছেÑ রাজস্ব আদায়ে যেখানে প্রত্যক্ষ করে গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল সেখানে পরোক্ষ করে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, কারণ সেটা করা তুলনামূলক সহজ। অন্য দিকে অতি ধনীদের থেকে যদি কর আদায় করতে না পারি তা হলে কর ন্যায্য হবে না। কালো টাকা সাদাকরণে ১৫% করের ব্যাপারেও তীব্র নিন্দা জানাই। সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া উচিত এবং আশা করি পরবর্তীতে সংশোধিত বাজেটে এটি বাদ যাবে। সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি হয়েছে এবং এখনো ভারসাম্য আসেনি।
আমাদের ঘাড়ে আগামীতে ঋণের বোঝা আরো বাড়বে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ঋণ নিয়ে যেই মেগা প্রকল্প করা হয়েছে সেগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা দরকার। ঋণ পরিশোধের সময়ও কম দেয়া হয়। আমাদের কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রাতেই ঋণ পরিশোধ করতে হবে।অন্য দিকে ঋণখেলাপির পরিমাণ বাড়ছে ব্যাংকে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা কেন ব্যবস্থা নিতে পারছি না? প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কোনো কিছুর সাথেই বাজেটের সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। সরকার স্ববিরোধিতা করছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন এত বছরেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে না? আমাদের জ্বালানি খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের যেই পাথেওয়ে রয়েছে সেটি এখনো বাজেটে সুনির্দিষ্ট না।
সানেমের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করে বলা হয়, যে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ২ বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থাকা দরকার যাতে ব্যবসার আস্থা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা বাড়ে। এছাড়া ব্যাংকে আমরা যারা ডিপোজিট করছি তারা যেন আস্থা ফিরে পাই। এছাড়া দুর্নীতির ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত এবং সংসদীয় কমিটি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দুর্নীতির বোঝা বহন করতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। দুর্নীতির জায়গায় আমরা জিরো টলারেন্স দেখতে চাই।
এক প্রশ্নের জবাবে ড. বিদিশা বলেন, রেমিট্যান্স দাতাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি অনার্থিক প্রণোদনার প্রয়োজন। সামাজিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন- তাদের জন্য বিমানবন্দরে আলাদা সুবিধার ব্যবস্থা করা, তাদের গ্রামে যেয়ে তাদের একটি বিশেষ স্বীকৃতি প্রদানসহ নানারকম অনার্থিক প্রণোদনা দেয়া সম্ভব।
অন্য দিকে, কার্যকরী ব্যয়ের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন ক্ষেত্রে ২২% বরাদ্দের প্রয়োজন কতটুকু? নানা ধরনের বিলাস বহুল বিষয় অর্থাৎ বিলাসদ্রব্য, আমদানি দ্রব্য, বিদেশ ভ্রমণ, আপ্যায়ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে সাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের স্বস্তি ও তাদের সুবিধার ক্ষেত্রে বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রসঙ্গে ড. সেলিম রায়হান বলেন, ক্রলিং পেগকে আরো নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিতে হবে। যদি প্রশাসনিক এক্সচেঞ্জ রেট রেখে দেয়া হয় বা ব্যান্ডটি পরিষ্কার না করা হয়, সে ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে বাজারভিত্তিক এক্সচেঞ্জ রেটের দিকে যেতে হবে। যত দেরি হবে, তত বেশি ধাক্কা খেতে হবে অর্থনীতিকে। তাই আমরা জানতে চাই ক্রলিং পেগ ঠিক কতটুকু ক্রল করতে পারে? কালো টাকা সাদাকরণের চেয়েও কিভাবে কালো টাকা হচ্ছে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্নে বলতে গেলে বলতে হয় ১ বছর আগের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবস্থা অনেক খারাপ হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে এই উদ্বেগের মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া প্রসঙ্গে ড. বিদিশা বলেন, পদক্ষেপটি আমাদের অর্থনীতির দর্শনের নীতিবিরুদ্ধ। এ পদক্ষেপের কারণে যারা সৎভাবে ব্যবসা করবে, তারা নিরুৎসাহিত হবে।
প্রেজেন্টেশন উপস্থাপনা করে সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, বর্তমানে অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে সবার আগে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছেÑ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নেতিবাচক প্রবণতা ও সার্বিকভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য কমানো এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার চ্যালেঞ্জও আমাদের সামনে রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসাটা মুখ্য চ্যালেঞ্জ।
কর্মসংস্থান তৈরিতে সুনির্দিষ্ট সুচিন্তিত পদক্ষেপ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। কর্মসংস্থান উজ্জীবিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। শ্রমঘন শিল্পগুলোতে বিনিয়োগ ও নতুন শ্রমঘন শিল্প তৈরি করা এবং তাদেরকে সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে ছোট ছোট প্রণোদনা দেয়া কার্যকর হতো, তবে সে জায়গায় তেমন উদ্যোগ আমরা লক্ষ্য করিনি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতেও উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল। সে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১৭ শতাংশ বরাদ্দ থাকলেও পেনশন, বৃত্তি ও সঞ্চয়পত্রের সুদ বাদ দিলে তা ১১ শতাংশে দাঁড়ায়।
সেলিম রায়হান বলেন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর বোঝা বেড়েই চলেছে। মোবাইল এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, এটির উপর কর বাড়ানোতে নিম্ন আয়ের মানুষের উপর বোঝা বেশি পড়বে। অন্য দিকে, ধনীদের একটা বড় অংশ করের আওতার বাইরে।
বাজেট পর্যবেক্ষণকারী সানেমের গবেষক দলে ছিলেন, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, গবেষণা পরিচালক ড. সায়েমা হক বিদিশা, জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী ইসরাত হোসাইন, ইশরাত শারমিন, আফিয়া মুবাশশিরা তিয়াশা, গবেষণা সহযোগী খন্দকার ইফফা, সাফা তাসনিম ও গবেষণা সহকারী নাফিসা জামান।