২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপিত হয়েছে। রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদে বাজেট উপস্থাপনের পরদিন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করা হয়। অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রাণবন্ত ছিল সংবাদ সম্মেলন। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অর্থমন্ত্রীর মেজাজ হারিয়ে বিরক্তি প্রকাশ ও প্রশ্নের অবমূল্যায়ন করা বক্তব্যে একাধিকবার হাস্যরসের সৃষ্টি হয় সংবাদ সম্মেলনে। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনের মঞ্চে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারকে বর্জনের ঘোষণা দেন উপস্থিত সাংবাদিকরা।
গতকাল বেলা ৩টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সঞ্চালনা করেন অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার। শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
অর্থমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য পড়া শেষ হলে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব।
সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অর্থমন্ত্রী বারবার প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ও অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দ্বারস্থ হন। প্রথম থেকেই বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে বিরক্তবোধ করেন অর্থমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তিনি বাজেটের নানা বিষয়ে করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের মান এবং ম্যাচিউরিটি নিয়েও পাল্টা প্রশ্ন করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের বিষয়ে যে পর্যায়ের প্রশ্ন আশা করেছিলাম সে রকম হয়নি। তবে বেশ কয়েকজনের প্রশ্ন বেশ ভালো ছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা একেবারেই নন-সিরিয়াস প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যোগ্য না আমি। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি একটু ম্যাচিউরড প্রশ্ন আশা করেছিলাম। আমি খুবই নিরাশ হয়েছি। আপনারা আরও একটু পড়ে আসবেন। এভাবে অতি সরলীকরণ করবেন না। একটু ম্যাচুউরিটি নিয়ে আসেন।
যারা আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত তাদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা তো খোলাখুলি সব বলেছি। কোনো রাখঢাক করিনি। আপনি ঘুরেফিরে একই কথায় যাচ্ছেন কেন? এইটা তো বুঝতে পারলাম না। এটা কী ধরনের প্রশ্ন! কীভাবে প্রশ্ন করে এগুলো একটু শিখতে হবে তো। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে। এটা কোনো জার্নালিজম না। খালি এক কথাই ঘুরে ফিরে বলেন। এগুলো একটু দেখেন। দেখে একটু শেখেন। তাহলে আমাদেরও কাজ করতে সুবিধা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বয়কট: অর্থমন্ত্রীর বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে বয়কটের ঘোষণা দেন উপস্থিত সাংবাদিকরা। ফলে পুরো সময়ে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। প্রশ্নোত্তর পর্বের শুরুতেই সাংবাদিকদের পক্ষে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মৃধা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে রেখেছেন। আমরা এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানালেও গভর্নর মানেননি। এজন্য গভর্নরের বক্তব্য আমরা বয়কট করবো। এ সময় গভর্নর অর্থমন্ত্রীকে ইশারা দিয়ে বলেন, তিনি বক্তব্য রাখবেন না।
উল্লেখ্য, রীতি অনুযায়ী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের। ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্ট, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে থাকেন তিনি। তবে এবার সাংবাদিকরা অনুষ্ঠান শুরুর আগেই গভর্নরকে বয়কটের ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানের মাঝে অর্থ সচিব গভর্নরকে কথা বলার অনুরোধ করলেও আব্দুর রউফ তালুকদার কথা বলেননি।
পুরো সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেননি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারসহ অন্যরা। সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ সময় গভর্নরকে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়।
বেনজীরের সম্পদ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানের পর ব্যবস্থা: বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তথ্যানুসন্ধান করছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বলেছেন, এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া। অনুসন্ধান শেষ হলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।
মসিউর রহমান বলেন, বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে দুদক তথ্যানুসন্ধান করছে। দুদক তাকে হাজির হওয়ার জন্য সমন দিয়েছিল। তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে সংবাদপত্র মারফত জানতে পেরেছি। দুদকে হাজির হওয়ার জন্য সময় চেয়েছেন। দুদক তাকে সেই সময় দিয়েছে। তিনি দুদকে হাজির হলে তথ্যানুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ করতে দিতে হবে। তারপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা আরও বলেন, সরকারের কেউ কিন্তু বলেনি যে, তার (বেনজীর) বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। অনেকে আগাম বলে থাকেন, তার জেল হবে নাকি ফাঁসি হবে। সেটিও সঠিক নয়। কারণ অপরাধ করলেও তিনি দেশের একজন নাগরিক। তারও নাগরিক অধিকার রয়েছে বিচার পাওয়ার। তিনি অপরাধ করে থাকলে বিচারব্যবস্থার মাধ্যমেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা তথা অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ হিসেবে দেখানোর সুযোগ রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এর সূত্র ধরে প্রশ্ন ওঠে, বেনজীর আহমেদ ১৫ শতাংশ কর দিয়ে তার যাবতীয় সম্পদ বৈধ করে নিতে পারবেন কি না। এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, তার (বেনজীর) বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো সত্য হলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে বিচার হতে পারে। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়কে বৈধ করার সম্পর্ক নেই।