এবারের বাজেট ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে জোর দেওয়া হয়েছে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে। নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ভ্যাট হার, আমদানি শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্ল্যান্ট, ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে পণ্যের উৎপাদন খরচে। কর ছাড় কমিয়ে আনার খক্ষ নামবে স্থানীয় শিল্পে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক-এই তিন ধরনের কর বা রাজস্ব আদায় করে। সরকারি-বেসরকারি সব শ্রেণির মানুষের আয়ের ওপর নির্দিষ্ট হারে আয়কর আদায় করা হয়। আর ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক আদায় করা হয় দেশের অভ্যন্তরে পণ্য উৎপাদন বা আমদানিতে। সাধারণত ভ্যাট বা আমদানি শুল্ক বাড়ানো হলে ধনী-গরিব সব পর্যায়ের মানুষের ওপর পড়ে, পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এ অবস্থায় ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক বাড়ানোয় আরও চাপে পড়বে ভোক্তা।
এবার বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির কারণে আয় কমলেও বছর শেষে আগের নিয়মে আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ বার্ষিক আয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা পেরুলে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাসিন্দাদের ন্যূনতম ৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। এছাড়া অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার ক্ষেত্রে ৪ হাজার টাকা এবং অন্য জেলা, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের করদাতাদের জন্য ৩ হাজার টাকা ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।
অবশ্য ধনীদের এবার অতিরিক্ত করারোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে ধনিক শ্রেণী ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়, আগামীতে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। বছরে আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেরুলে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের আবগারি শুল্কও বাড়ানো হচ্ছে। ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক হিসাব থেকে বছরে এক লাখ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হতে পারে।
অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে বাজেটে। আইএমএফের পরামর্শে কর ব্যয় কমিয়ে আনতে স্থানীয় শিল্পের কর অবকাশ ও ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা সংকুচিত করে আনা হচ্ছে। এতে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। যেমন সরকারের নীতি সহায়তার কারণে দেশে গঠে ওঠা ইলেকট্রনিক্স শিল্পের ভ্যাট ছাড় সুবিধা সংকুচিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি এসি ও এলইডি টিভি তৈরির উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে দেশে এসি ও টিভির দাম বাড়তে পারে।
মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। এতে ভোক্তার খরচ বাড়বে। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসাবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তারা ৬৮ টাকার কথা বলতে পারবেন।
যুব সমাজের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এনার্জি ড্রিংকস ও কার্বোনেটেড বেভারেজের টার্নওভার কর দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এ কারণে কার্বোনেটেড বেভারেজ ও এনার্জি ড্রিংকসের দাম বাড়তে পারে। এর সঙ্গে সিগারেটের মূল্যস্তর ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বিধায় ধূমপায়ীদের খরচ বাড়ছে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
নারীরা রূপচর্চা করতে পছন্দ করেন। বাজেটে রূপচর্চা সামগ্রীর ওপরে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। হাত, নখ, পায়ের প্রসাধনসামগ্রী, লিপস্টিক, চুল পরিচর্যাসামগ্রী সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে বিধায় কসমেটিক্স আইটেমের দাম বাড়তে পারে। অবসরে পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য অনেকে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ঘুরতে যান। রাজস্ব আয় বাড়াতে সেখানেও হাত দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে পার্কে ঘোরার খরচ বাড়বে। ফলের জুস, আমসত্তের দাম বাড়তে পারে। কারণ, সরবরাহ পর্যায়ে এসব পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এটি বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে।
কালোটাকা সাদা করতে বিশেষ সুবিধা : বাজেটে কালোটাকা সাদা করতে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে প্রথম ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের ‘বিশেষ’ সুযোগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে বর্গমিটার প্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তখন ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করেন। বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আগের মতো আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ উদ্যোগ থাকছে। এক্ষেত্রে আগের মতোই অ্যামনেস্টি সুবিধা থাকছে। অর্থাৎ সরকারের অন্য কোনো সংস্থা এ বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না।