মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক পাঠানোর আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। কর্মী পাঠানোর খরচের বাইরেও মেডিকেল টেস্ট ফি’র নামে একেকজনের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এজেন্সিগুলো সরকার নির্ধারিত খরচের কথা বললেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ ধরনের কোনো নির্দেশনা নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে অনুসন্ধান শুরুর পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোয় একজন কর্মী বাবদ কতো টাকা খরচ ও মেডিকেল টেস্ট ফি নেয়া হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়।
দুদক সূত্র জানায়, জবাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো জানায়, তারা সব যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়েছে। একইসঙ্গে মেডিকেল ফি’র বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো সরকার নির্ধারিত টাকায় কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে বলে জানিয়েছে দুদককে।
পরবর্তীতে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা অনিয়মের বিষয় খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি পাঠান। চিঠিতে রিক্রুটিং এজেন্সির নিজস্ব মালিকানাধীন মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন রয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। একইসঙ্গে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি নির্ধারণে কোনো নিদের্শনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রয়েছে কিনা তাও জানতে চান দুদক কর্মকর্তা।
চিঠির জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা দুদককে জানায়, বেশ কয়েকটি মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন থাকলেও বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি’র ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই।
দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে আমরা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। প্রথম দিকে চিঠির কোনো জবাব পাইনি।
পরবর্তীতে আবারো চিঠি দিলে তারা জানায় যথাযথ নিয়ম মেনে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। এসব মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদন পেলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি’র বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা) মঈনুল হাসান বলেন, দুদক আমাদের চিঠি দিয়েছিল। বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুন কিংবা ফি নির্ধারণে আমাদের হস্তক্ষেপ নেই। নির্দেশনাও নেই।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল। রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক এমএ সোবহান ভূঁইয়া, যিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যানও। শুধু কর্মী পাঠানো নয়, বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আল গোফিলি মেডিকেল সেন্টার নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। বিনিময়ে ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে যারা মালয়েশিয়ায় যান, তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা গোফিলি মেডিকেল সেন্টারেই করা হয়।
এ ছাড়াও ওই অনুসন্ধানে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিক ইস্টার্ন, আল ইসলাম ওভারসিজ কনসালট্যান্স লিমিটেড, প্রান্তিক ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেড, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, প্যাসেজ এসোসিয়েটসসহ অন্তত ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের বিরুদ্ধে কর্মী পাঠানোর নামে অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে।
গত বছরের ২৩শে নভেম্বর দুদকের কমিশন সভায় মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আড়ালে টাকা হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। সংস্থাটির উপ-পরিচালক আবু সাঈদকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে বর্তমানে অনুসন্ধানের দায়িত্বে রয়েছেন সহকারী পরিচালক আমিনুল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি কয়েকদিন আগেই ফাইল পেয়েছি। এখনো স্টাডি করা শেষ হয়নি।
কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়ায় যেতে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ খরচ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। ২০২২ সালে এক অফিস আদেশে এই খরচ নির্ধারণ করেছিল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই আদেশ না মেনে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছুক একেকজন কর্মীর কাছ থেকে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করেছে। এই প্রক্রিয়ায় গত দুই বছরে মালয়েশিয়ায় যাওয়া ৪ লাখ কর্মীর কাছ থেকে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট।
বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী পাঠাতো। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে নতুন একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে দুই দেশ। সেই সমঝোতায় রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ১০টি থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা হয়। তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি বিদেশগামী কর্মীদের। ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে ১০০ এজেন্সিকে দায়িত্ব দেয়া হলেও সেখানেও তৈরি হয় নতুন সিন্ডিকেট। ২০-২৫টি এজেন্সির এই সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করছে মালয়েশিয়ার কর্মী পাঠানোর কাজটি।