আশি-ঊর্ধ্ব প্রবীণ অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আর একদিন পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। নয়া দিগন্তসহ দু-একটি গণমাধ্যম বাজেটের সম্ভাব্য অঙ্কও প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে নতুন অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। এটি আগের বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ মতো বড় হবে। যেখানে টাকার মান সঙ্কোচক ১০ শতাংশের কাছাকাছি এবং অর্থনীতির বিকাশ হার ৭ শতাংশের কোটায়, সেখানে চলতি মূল্যে ৪ শতাংশ বাজেট বৃদ্ধি শুরুতে এ বার্তা দেয় যে, অর্থনীতিকে সঙ্কোচনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সরকারের প্রকৃত ব্যয় ১২/১৩ শতাংশ কমানোর পর সাড়ে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন।
নতুন অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতি থাকবে দুই লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। যা কি না জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ বিশাল অঙ্কের ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার টার্গেট লাভ হচ্ছে। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশ থেকে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার সহায়তা পাওয়া যাবে বলেও ধরা হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণও রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারি চাকুরেদের ‘জিপিএফ’ থেকে নেয়া হবে আরো পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
সঙ্কটে অর্থনীতি?
অর্থনীতি যে সঙ্কটে রয়েছে তা স্পষ্ট হয় নতুন বছরের বাজেট নির্ধারণে। এ বাজেটের ব্যাপারে প্রকাশ হওয়া তথ্যসমূহ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অর্থনীতি এখন এক দুষ্টচক্রে পড়ে গেছে। সরকার অর্থনীতির বিকাশ হার দেখাচ্ছে আকর্ষণীয় করে। কিন্তু প্রতি বছর বাজেটে যে লক্ষ্য ঘোষণা করা হচ্ছে; তা অবাস্তবায়িত থেকে যাচ্ছে। অর্থ খরচের বিবেচনায় ২০২৩ অর্থবছরে বাজেট অবাস্তবায়িত থেকে গেছে ১১ শতাংশের মতো। বিদায়ী অর্থবছরে এ হার আরো বাড়তে পারে। কারো কারো ধারণা, এবার সরকারের রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্তির যে প্রবণতা; তাতে বছর শেষে মূল বাজেটের ৮৫ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন করা যাবে না।
সাধারণত বাজেট বাস্তবায়নের মাঝামাঝি এসে যখন দুরবস্থা দেখা যায়, তখন সংশোধিত বাজেটে একদফা কমানো হয় ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা। এরপর সে সংশোধিত বাজেটও বাস্তবায়ন করা যায় না। কেন এ পরিস্থিতি দেখা যায়? এর প্রধান কারণ হলো- সরকারের রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী করা যায় না। বাংলাদেশে সরকার সব সময় একটি গতানুগতিক কাঠামোতে দাঁড়িয়ে বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। প্রথমে ঠিক করে নতুন বছরের সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় কী হতে পারে। এর মধ্যে সরকারের প্রয়োজনীয় পরিচালন ব্যয়কে খুব একটা এ দিক-সে দিক করা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেভাবে সরকার বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প অনেকটা বাণিজ্যিক হারের সুদে ঋণ নিয়ে বাস্তবায়ন করছে, তাতে সুদের ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে বিদেশী ঋণের দায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের কোটায় উঠে গেছে।
এক দিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় এ ঋণের দায় টাকার চলতি মূল্যে বাড়ছে। অন্য দিকে বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার মূল্য দিতে গিয়ে রেয়াতি ঋণ হারাতে হচ্ছে। ফলে বিদেশী ঋণের জন্য সুদ দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের ঋণমানের অবনতিতে অর্থপ্রাপ্তি সঙ্কোচিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা।
এ অবস্থায় বাড়তি বিদেশী ঋণ নেয়া মানে বাজেটে সুদের চাপ বেড়ে যাওয়া। বিনিময় হারের অস্থিরতায় বাজেটে সুদের চাপ কমানোর জন্য প্রয়োজন হলো ব্যয়বহুল বিদেশী ঋণ না নেয়া। সমস্যা হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে চাপ এর মধ্যে তৈরি হয়েছে তাতে বিদেশী ঋণ না নেয়া হলে মজুদ আরো কমবে।
বৈদেশিক খাতে চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশ সরকারের নীতি অনুসারে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ কত তা জানানো হয় না। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পর্ষদ সভায় বোর্ড সদস্যরা প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তা জানাতে অস্বীকৃতি অপারগতা জানায়। ধারণা করা হয়, গভর্নরসহ হাতেগোনা দুই-তিন কর্মকর্তার বাইরে বাকিরা রিজার্ভের প্রকৃত অঙ্ক জানেন না। যে অঙ্ক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশ করে; তাতে যে হিসাবের মারপ্যাঁচ আছে সেটি বৈদেশিক লেনদেনের তথ্য পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়। এই মারপ্যাঁচের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক লেনদেনে সাময়িকভাবে যে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ট্রানজিট হিসাবে কয়েক দিনের জন্য থাকে সেটিকে রিজার্ভ গণ্য করা। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময় থেকে এটি রিজার্ভে ধরা হয়। আবার রিজার্ভের স্বর্ণ ও বিদেশী বন্ডের মূল্য সব সময় হালনাগাদ না করে রিজার্ভে প্রদর্শনের অভিযোগও রয়েছে।
এর বাইরে একসময় রিজার্ভের অর্থ উন্নয়ন প্রকল্পসহ অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রে ব্যয় করার পরও তা আবার হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। আইএমএফের চাপে সেটি বাদ দিয়ে রিজার্ভের নিট হিসাব এখন দেখানো হচ্ছে। এর বাইরে রিজার্ভ যাই দেখানো হোক না কেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধের প্রকৃত সক্ষমতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ সক্ষমতা যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন চলতি বাণিজ্যিক লেনদেনের দায় বকেয়া পড়ে যায়। এ ধরনের স্থগিত এলসি পেমেন্টের অঙ্ক বাংলাদেশে এখন যে রিজার্ভ দেখানো হচ্ছে তা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা যাচ্ছে।
রিজার্ভের এ চাপ মোকাবেলায় সরকার সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছ থেকে বাকিতে তেল কেনার বিষয়ে দেনদরবার করছে। সেই সাথে বাজেট সহায়তায় চীনসহ বিভিন্ন দেশের কাছে ধরনা দিচ্ছে। আইএমএফের ঋণের কিস্তি প্রাপ্তির জন্য কঠিন সব শর্ত কবুল করছে সরকার।
এর মধ্যে পরিস্থিতি জটিল রূপ নিচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে হিসাব না করে বিদেশী বিনিয়োগে গ্যাস বিদ্যুৎপ্রাপ্তির চুক্তি করায়। গ্যাস খাতে একসময় পেট্রোবাংলা বা বাপেক্সের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে নিষ্ক্রিয় রেখে বিদেশী কোম্পানিকে গ্যাস উত্তোলনে ব্লক ইজারা দেয়া হয়েছে। এমনকি স্থলভাগের সহজসাধ্য গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রও বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া হয়। এর ফলে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে এসব ক্ষেত্র থাকলে যে মূল্যে রাষ্ট্র গ্যাস সরবরাহ পেত, তার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি দামে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) থেকে গ্যাস সরবরাহ নিতে হচ্ছে। আর আইসিওগুলো তাদের মুনাফার অর্থ বিদেশী মুদ্রায় নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায় বলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে। একই চিত্র বিদ্যুৎ খাতেরও। দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ নানা কারণে দেশী ও বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে সরবরাহ নিতে চুক্তি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানি আদানির সাথে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি দেশী বিদেশী গণমাধ্যমের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গ্যাস সরবরাহকারী আমেরিকান কোম্পানি শেভরনের বকেয়া গ্যাসের টাকা আর আদানির বকেয়া বিদ্যুতের অর্থ পরিশোধে দুই দেশ থেকে সম্প্রতি চাপের বিষয় গণমাধ্যমে এসেছে।
এভাবে বিদেশী মুদ্রার দায় বৃদ্ধিতে বৈদেশিক খাতে এক ধরনের চাপে রয়েছে সরকার। এ চাপ আগামী অর্থবছর থেকে আরো প্রবল হয়ে উঠবে বড় বড় প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধের তাগাদা শুরু হলে। এতে আগামী বছরগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে বিদেশী ঋণের দায় শোধের অঙ্ক। সমাপ্ত অর্থবছরে মোট বিদেশী ঋণের অন্তঃপ্রবাহের ৪০ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। আগামীতে বিদেশী ঋণ গ্রহণ নির্ধারিত মাত্রা পেরিয়ে গেলে নতুন বিদেশী সহায়তাপ্রাপ্তি কমে যাবে আর তাতে একপর্যায়ের শতভাগ বিদেশ ঋণের অর্থ সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়ে যেতে পারে।
ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে অর্থনীতি?
ঋণের জালে আটকে যাওয়ার এ চিত্র শুধু বিদেশী দায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন নয়। যে বাজেট ৬ জুন ঘোষণা করা হচ্ছে তাতে যে দুই লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকবে আর তার অর্ধেক অর্থ ব্যাংক খাত থেকে নেয়া হবে। এতে ব্যাংক খাতের বেসরকারি অংশে যে বিনিয়োগ ক্ষমতা তা কমে যাবে। এমনিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একটি সন্ধিক্ষণে চলে এসেছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। ‘কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই’ অবস্থা অনেক বড় বড় ব্যাংকের। সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগ করে ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন এবং এরপর নামে-বেনামে গ্রাহকের আমানতের অর্থ বের করে নেয়ার বিষয় দেশের গণমাধ্যম ছাড়িয়ে বিদেশী মিডিয়াতেও প্রকাশ হচ্ছে। কয়েক লাখ টাকার চেক নিয়ে অনেক বড় মাপের ব্যাংক থেকে টাকা না পেয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা হচ্ছে এখন অনেক গ্রাহকের। এ অবস্থায় ব্যাংক থেকে সরকার যদি এক বছরে এক লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়; তাহলে বেসরকারি খাতের অবস্থা কী হবে?
জমিদার বাড়ির পতনের ঘটনা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের একটি সিরিয়াল বাংলাদেশ টেলিভিশনে একসময় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এতে দেখা যায়, জমিদাররা তাদের মান-মর্যাদা ধরে রাখতে গিয়ে খরচের অঙ্ক কমাতে পারতেন না। আয় কমে গেলে তাতে সম্পদ বিক্রি করে খরচের জোগান দিতে হতো। একপর্যায়ে পুরো জমিদারি নিলামে উঠত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ রকম এক সিনড্রম দেখা যেতে শুরু করেছে। সরকার বাজেটের খরচ যেখানে নিয়ে গেছে, তাতে প্রশাসন চালানো ও সুদের ব্যয় আর কমাতে পারছে না। যেসব উন্নয়ন প্রকল্প এর মধ্যে নেয়া হয়েছে তার ধারাবাহিকতায় এবং জনতুষ্টির জন্য আরো কিছু উন্নয়ন প্রকল্প না নিয়ে সরকার চালানো কঠিন। ফলে উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। আর রাজনৈতিক আনুকূল্যপ্রাপ্ত অভিজাত এবং বিদেশীদের মধ্যে যারা ক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করছে তাদের কোম্পানিকে লাভজনক বাণিজ্যের সুবিধা দিতে হচ্ছে। এসব কিছুর সামাল দিতে আয়ের একমাত্র সূত্র থাকছে জনগণের ওপর করারোপ। এ করের বোঝায় চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ায় অনেককে আবার ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হচ্ছে।
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ওপর করারোপের অবস্থাও এখন আগের মতো নেই। ডলারের সঙ্কটের সামাল দিতে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয় ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামাতে হয়েছে। এর পরও যে চাপ ডলারের ওপর তৈরি হয়েছে তাতে আমদানি ব্যয় এখনকার তুলনায় ৫০ ভাগ অর্থাৎ আড়াই বিলিয়ন ডলারে নামাতে সুপারিশ করা হয়েছে। এটি যদি কার্যকর করা হয় তাহলে রাজস্ব কোথা থেকে আসবে সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্বপ্রাপ্তি ঠিক করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ছিল পাঁচ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। নতুন রাজস্বপ্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারো বেশির ভাগ আয় করার দায়িত্ব থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের ওপর। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তির টার্গেট থাকছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ৬ মাসে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা, যা সারা বছরের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩৭.৫৫ শতাংশ। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাকি ৬ মাস সময়ে ৬৩ শতাংশের মতো রাজস্ব আদায় করতে হবে। ৬ মাস সময়ে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ। যদিও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ৩৬ শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজন ছিল।
রাজস্ব আদায়ের এ ঘাটতি পূরণে এবার ভ্যাটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে, এনবিআর বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার ওপর মূল্য ভিত্তি হিসাব করে ২, ৩, ৫, ৭.৫, ১০ এবং ১৫% হারে ভ্যাট সংগ্রহ করে। জানা যাচ্ছে, এবার সেটি ১৫ শতাংশের অভিন্ন ভ্যাট হারে নেয়া হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে মোবাইল ফোনে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এভাবে রাজস্ব আহরণে বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়া হলে চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।
অর্থনীতিতে রাজনৈতিক প্রভাব
রাজনীতির প্রভাব অর্থনীতিকে যখন প্রবলভাবে আক্রান্ত করে তখন অর্থনীতির পঙ্গু অবস্থা তৈরি হয়। বাংলাদেশের বিগত তিনটি নির্বাচন হয়েছে একতরফা ও বিরোধী দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে। এ ধরনের নির্বাচনের পর ক্ষমতা বৈধকরণে বিদেশী প্রভাবশালী দেশের নানা স্বার্থ রক্ষা করতে হয়। একই সাথে লালন করতে হয় দেশী অলিগার্কদের। অর্থনীতির ব্যাকরণ ও জাতীয় স্বার্থ মেনে এটি করা সম্ভব হয় না। এতে জাতীয় সম্পদের একটি অংশ চলে যায় বিদেশীদের কাছে, ঠিক এখন যেভাবে গ্যাস, জ্বালানি ও বিদ্যুতের লাভের অঙ্ক আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতে চলে যাচ্ছে। একই সাথে স্থানীয় বাণিজ্য ও উৎপাদনের যেসব লাভজনক উপকরণ রয়েছে তা স্বাভাবিকতার বাইরে আনুকূল্যপ্রাপ্ত অলিগার্কদের কাছে জমা হচ্ছে। এভাবে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতেগোনা কয়েকজনের হাতে চলে গেছে। ভোগ্যপণ্যের আমদানি এবং দেশের ভেতরের বড় বড় ব্যবসা তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। বিদ্যুতের বেসরকারি সরবরাহকারীও হাতেগোনা কয়েকজন। এটি অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশের কোনোভাবেই অনুকূল হয় না। সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের স্বাভাবিক যে ম্যাকানিজম সেটিও এ অবস্থায় পুরোপুরি কাজ করে না।
এ লেখায় সংযুক্ত টেবিলের প্রতি নজর দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের অর্থনীতির অর্জন সরকার যাই বলুক না কেন; এর মধ্যে একটি ফাঁপা অবস্থা থেকে যাচ্ছে। ডলারের হিসাবে গত দুই বছর বাংলাদেশের বাজেট ব্যয় রাজস্ব আয় এমনকি অর্থনীতির আকারও সঙ্কুচিত হয়েছে। এবার আরো সঙ্কুুচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর কিছু বিশ্লেষক আসন্ন অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রতি ইঙ্গিত করে ডলারের দাম ২০০ ছাড়ানোর যে কথা বলছেন তা যদি বাস্তবে রূপ নেয় তাহলে কী হতে পারে তা বুঝতে কল্পনাশক্তিকে আরো ধারালো করতে হবে।
mrkmmb@gmail.com