ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধের প্রতিপাদ্য সামনে রেখে চলতি বছর পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল নতুন করে মরুকরণ ও খরার ঝুঁকিতে রয়েছে। কমে যাচ্ছে দেশের ৭৬ শতাংশ জমির গুণগত মান। সেই সঙ্গে রয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের নানা নেতিবাচক প্রভাব।
দেশের উত্তর বা বরেন্দ্র অঞ্চলে মূলত খরা দেখা গেলেও ভবিষ্যতে তা দেশের মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলেও বিস্তৃত হতে পারে।
জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের সেচের পানির ৮৬ শতাংশ ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। সেচের ক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে বাছাইকৃত দেশগুলোর শীর্ষ পাঁচে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট সেচের পানির প্রায় ৯৪ শতাংশ ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করে শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান।
এর পরেই সৌদি আরবে তা ৯২ শতাংশ, ভারতে ৮৯ শতাংশ, সিরিয়ায় ৮৭ শতাংশ, মেক্সিকোতে ৭২ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৭১ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। জাতিসংঘের সঙ্গে মিলিয়ে সরকার এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে, ‘করব ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখব মরুময়তা/অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান ‘আমাদের ভূমি, আমাদের ভবিষ্যৎ’।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মিলনের তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শাবিস্তা ইলদিজ সম্প্রতি দেশের খরার ভবিষ্যৎ চিত্র নিয়ে একটি গবেষণা করেন। এটি বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী স্প্রিঞ্জারের ‘আর্থ সিস্টেম অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এ প্রকাশিত হয়। গবেষণায় বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, সোলার রেডিয়েশন ও বাষ্পীভবনের উপাত্তের ভিত্তিতে গ্লোবাল ক্লাইমেট মডেলের ডাটা বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের খরার চিত্র কেমন হতে পারে তা তুলে ধরা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সুদূর ভবিষ্যতে (২০৬০-৭৯) খরার বিস্তৃতি ও সংখ্যা বাড়তে পারে। সুদূর ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে খরার হার বাড়তে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি খরা (ছয় মাসের বেশি) অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণাঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, যা সুদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে ছড়াতে পারে।
গবেষণায় ১৯৮৫ থেকে ২০১৪ সালের মোট ৩০ বছরের আবহাওয়া ও খরার উপাত্তকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খরার চিত্র কেমন হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অদূর ভবিষ্যতে (২০২০-৪৯) বাংলাদেশে খরার হার কমার ইঙ্গিত থাকলেও সুদূর ভবিষ্যতে (২০৬০-৭৯) আবার তা বাড়তে পারে।
খরার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন
ঐতিহ্যগতভাবে খরাপ্রবণ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য হারে খরা বাড়বে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি খরা বাড়তে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি খরা বাড়তে পারে। দূর ভবিষ্যতে দেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে খরার তীব্রতা বাড়বে। খরা সংঘটন ও এর তীব্রতা বাড়লে তা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, স্রোত প্রবাহ, কৃষি-সংস্কৃতি, প্রতিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।
তাপমাত্রার পরিবর্তন
২০২০ থেকে ২০৭৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার তুলনায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়তে পারে। ফলে দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে আসবে। এর ফলে মানুষের মধ্যে তাপজনিত অস্বস্তি বাড়বে, যা স্বাস্থ্য ও কৃষির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি বাড়বে। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের কিছু অংশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা উচ্চহারে বাড়তে পারে। ২০২০ থেকে ২০৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বাষ্পীভবনের হার সামগ্রিকভাবে বাড়বে। সুদূর ভবিষ্যতে এটি উচ্চহারে বাড়তে পারে, বিশেষ করে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এটি সামান্য কমতে পারে।
এ বিষয়ে মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান মিলন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের যেসব অঞ্চলে নতুন করে খরার আশঙ্কা রয়েছে সেসব অঞ্চলের, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষির জন্য পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা সাজাতে হবে। উত্তরাঞ্চলের খরা ব্যবস্থাপনা উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিবেশ ও পরিবেশে কাজ না-ও করতে পারে। খরা নিয়ে তাই আরো গবেষণা করে তা মোকাবেলার জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।’
মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান আরো বলেন, ‘যে দেশে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত দুই হাজার ২০০ মিলিমিটারের ওপর সেখানে খরা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাদের সমস্যা হচ্ছে সঠিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাব। অঞ্চলভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তাই জোর দিতে হবে।’
ভূমি অবক্ষয় ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর
বাংলাদেশের ভূমির গুণগত মান কমা নিয়ে সরকারি সংস্থা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ‘বাংলাদেশ ভূমি অবক্ষয়, ২০২০’ শীর্ষক একটি গবেষণা চালায়। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। ওই গবেষণা বলছে, দেশের মোট এক কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর ভূমির মধ্যে এক কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিই অবক্ষয়ের শিকার, যা মোট ভূমির ৭৬.১ শতাংশ। প্রতিবছর গড়ে ২৭ হাজার হেক্টর ভূমির অবক্ষয় হচ্ছে। গবেষণাটি বলছে, মূলত মাটির রাসায়নিক গুণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, পানির স্তর নেমে যাওয়া, জলাবদ্ধতা, খরা ইত্যাদি কারণে ভূমি অবক্ষয় হয়ে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
এ বিষয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উজানের পানির অভাবে আমাদের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। এর সমাধান করতে হবে। জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করায় উর্বরতা কমে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। খরাসহিষ্ণুতা তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের সম্পূরক সেচ প্রকল্প নিয়েও ভাবতে হবে। আমাদের শতকরা ৭০ ভাগ সেচ হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ছে এবং স্তর নেমে যাচ্ছে।’
ভূমি পুনরুদ্ধার ও বনায়নে সরকারের পদক্ষেপ
সরকার বনায়ন ও বন সংরক্ষণ, অবক্ষয়িত বন পুনরুদ্ধার এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ২০০৯-১০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত মোট দুই লাখ ১৭ হাজার ৪০২ হেক্টর ব্লক এবং ৩০ হাজার ২৫২ সিডলিং কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান সৃজন এবং ১১ কোটি ২১ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে দেশজুড়ে আট কোটি ৩৩ লাখ ২৭ হাজার চারা রোপণ করা হবে।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/06/05/1394612