বাংলাদেশের জন্য ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা দুর্যোগ নতুন কোনো ঘটনা নয়। মাস কয়েক পরপরই আমাদেরকে নিম্নচাপ বা লঘুচাপের মুখোমুখি হতে হয়। কখনো কখনো নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয় আর সেই ঝড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় উপকূলীয় জেলার মানুষগুলো। সর্বশেষ বাংলাদেশ ও ভারতের একাংশের ওপর দিয়ে বয়ে গেলো ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এ ঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯ জেলায় ২২ জন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার। সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫টি বাড়িঘর। প্রায় তিন কোটি মানুষ ৪৮ ঘন্টারও বেশি সময় বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেমালে। জেলাগুলো হলো: খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং যশোর। এর মধ্যে শুধুমাত্র বাগেরহাট জেলাতেই মাছের ২২ হাজার ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। ১৫ হাজার মোবাইল ফোন টাওয়ার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ। সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, কক্সবাজারের ২০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। গাছপালা উপড়ে পড়েছে। অসংখ্য জমির উঠতি ফসল নষ্ট হয়েছে। বিপুল পরিমাণ হাঁস-মুরগি, গরু-মহিষ-ছাগল পানিতে ভেসে গেছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মানুষগুলোর জীবনীশক্তি অসাধারণ। এ অঞ্চলের জলবায়ু ও আবহাওয়ার যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে-আল্লাহ তায়ালা এগুলো সহ্য করার মতো মানসিক শক্তি স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রদান করেছেন। নতুবা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়, বা সাইক্লোন সিডর, ঘূর্ণিঝড় আইলা, আমফান কিংবা ফণীর পর যেভাবে এ মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা নজিরবিহীন।
কখনোই এ মানুষগুলো তাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথাযথ ত্রাণ সহায়তা পায় না। সরকারের ত্রাণ মন্ত্রনালয় জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে যেটুকু ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন প্রকল্পেও সরকারের তেমন কোনো সক্রিয়তা থাকে না। বেসরকারি নানা সংস্থা, এনজিওরাও এ সব দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকায় মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে, তবে এসব উদ্যোগের উপকারিতাও ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকার বাসিন্দারা পায় না। এরপরও প্রতিবার দুর্যোগের পরই তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু মানুষগুলোর এই ঘুরে দাঁড়ানোর কিংবা পুনরায় স্বাভাবিক জীবন শুরু করার এই কৃতিত্বটি বারবারই হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় প্রশাসন।
সরকার সাধারণত দু’ভাবে ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রথমত, আগাম পূর্বাভাস দেওয়া, আশ্রয় কেন্দ্র উম্মুক্ত করা এবং সেখানে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষগুলোকে নিয়ে আসা। যেমন এবারের রেমাল ঝড়ের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ঘূর্ণিঝড় সতর্কবার্তার প্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাসমূহে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৮ লাখের বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছিল। সরকারের কাজের আরেকটি কৌশল হলো ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে টাকা বরাদ্দ করা। যদিও এ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য আর যতটুকু টাকাও বরাদ্দ করা হয়, তার বড়ো অংশই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা হাতে পায় না। এবার রেমাল ঝড়ের ক্ষেত্রেও সরকার দাবি করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রদান করেছেন। এর মধ্যে পনেরোটি জেলায় জি আর (ক্যাশ) তিন কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, ৫ হাজার ৫শত মেট্রিক টন চাল, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশু খাদ্য ক্রয়ের জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ, গো খাদ্য ক্রয়ের জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে।
এই সাহায্য সহযোগিতার অনেকটুকুই শুধু কাগজে কলমেই থেকে যায়। কিন্তু দুর্গত মানুষগুলোর প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে আসলে কেউ পাশে থাকে না। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফেরত আসার পর খাবার, পানির অভাবে তাদেরকে দিনযাপন করতে হয়। তাদের আয়ের সংস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। নতুন করে আয়ের সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে ক্ষেতের ফসল, বাড়িঘর, গবাদি পশু, গাছপালা সবই ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ তাই আমাদের অর্থনীতি এ ধরনের দুর্যোগে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২.২ শতাংশ। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত ২০ বছরে ১৮৫টি আবহাওয়াজনিত তীব্র দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে; যার ফলে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ নবম। আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিষ্ঠানের মতে দুর্যোগ বিপন্নতায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বলা হয়, পৃথিবীতে সংঘটিত দুর্যোগগুলোর ৪৫ শতাংশই হয় এশিয়া মহাদেশে। আবার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ যে দেশগুলোতে হয় এর মধ্যে একেবারে প্রথম দিকেই রয়েছে বাংলাদেশ।
দুর্যোগ কবলিত এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষ বা যারা দিন আনে দিন খায় তারাই এ ধরনের দুর্যোগের ভিকটিম হয়। সরকার বা প্রশাসনের দিক থেকেও দুর্যোগ মোকাবেলায় অনেক ধরনের অপ্রতুলতা রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশ বরাবরই দুর্যোগ মোকাবেলা করে আসছে অথচ এরপরও এত বছরেও আমাদের প্রশাসন দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকরি অনেক কৌশলই অবলম্বন করতে পারেনি-যা নিতান্তই দুঃখজনক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্যোগ মোকাবেলায় একটি বড়ো সংকট হলো দেশের মোট জনগোষ্ঠীর কোনো সুনির্দিষ্ট ডাটাবেজ নেই। মোট জনসংখ্যার পেশা, বয়স, আয়, পারিবারিক নির্ভরশীলতা সংক্রান্ত যদি কোনো ডাটাবেজ থাকে তাহলে যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলা অনেকটা সহজ ও গোছানো হয়ে যায়। বিশেষ করে, উপকূলীয় অঞ্চলের কতসংখ্যক মানুষ চাকরিজীবী (পেশাভিত্তিক আলাদা), গাড়িচালক, কত সংখ্যক মানুষ নি¤œ আয়ের বিশেষ করে রিকশাচালক, চায়ের দোকানদার, ফুটপাতের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি, মজুর, পোশাক কারখানার কর্মী, মিল-কারখানার কর্মী, ব্যবসায়ী- প্রভৃতির তালিকা কিংবা ডাটাবেজ আজ পর্যন্তও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। কিছু পরিসংখ্যান হয়তো পাওয়া যায়। তবে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটু আঁচ পাওয়া গেলেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া যায় না।
দুর্যোগ প্রবণ এলাকা বিশেষ করে উপকূলীয় জেলায় বা উপজেলায় কিংবা একটি আশ্রয় কেন্দ্রের আওতায় কতসংখ্যক মানুষ আছেন আবার এর মধ্যে কত শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এবং কত ভাগ উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত রয়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা ডাটাবেজ থাকলে দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অনেকটা সহজ হয়ে যেতো। যদিও রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তিগত পরিসরে অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে দুর্যোগকবলিতদের পাশে ত্রাণ নিয়ে শামিল হয়েছেন। কিন্তু প্রশাসন সক্রিয় হলো বা কেন্দ্রীয়ভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ থাকলে ত্রাণ বিতরণে অব্যবস্থাপনা অনেকটাই কমে আসতো। কেননা অনেক সময়ই শোনা যায়, প্রকৃত ভিকটিমের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকা ব্যক্তিরাই ত্রাণ পান। আবার এমনও হয় যে, একই ব্যক্তি একাধিকবার ত্রাণ পান অথচ আরেকজন হয়তো একবারও পান না। আবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ আত্মসাতের নির্মম বাস্তবতা তো আছেই। এগুলো অনেকটাই হ্রাস পেতো যদি বিদ্যমান কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকতো।
দুর্যোগ মোকাবেলায় আরেকটি সীমাবদ্ধতা তৈরির কারণ হলো, প্রশাসন অনেকক্ষেত্রে দুর্যোগ আক্রান্ত একটি এলাকাকে ‘দুর্গত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করতে চায় না। এর নেপথ্যে দুটো কারণ আছে বলে জানা যায়। একটি কারণ হলো, এখনো মান্ধাতা একটি নিয়ম রয়ে গেছে যাতে বলা হয়েছে যে, ‘একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ হতাহত না হলে একটি স্থানকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় না।’ আর দ্বিতীয়ত, অনেকক্ষেত্রে আমলারাও এ ধরনের ঘোষণা দিতে বাধা দেন বলে অভিযোগ আছে। কারণ দুর্গত এলাকা ঘোষণা হয়ে গেলে কোনো এলাকা বাড়তি মূল্যায়ন পায়- যা তারা সহজভাবে মানতে চান না।
মূলত ‘দুর্গত এলাকা’ ঘোষণা করলে লাভ যা হয় তাহলো দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বরাদ্দের পরিমাণ একটু বেশি হয়। দুর্গত এলাকা ঘোষণা না করার মধ্যেও কোনো মহত্ত নেই। কেউ মারা যায়নি বলে, বিপুল সংখ্যক মানুষ এই দুর্যোগে ভোগান্তির শিকার হয়নি- এমনও নয়। মারা না গেলেও তাদের অনেকে এতটাই কষ্টে আছে যা অনেকটা মৃত্যুর সমতুল্য। বস্তুত আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষগুলো এভাবে কষ্ট পেতে পেতে কষ্টসহিষ্ণু হয়ে গিয়েছে। তারা এই বিপর্যয়ের মাঝেও বেঁচে থাকতে শিখে গেছে। সরকার বা প্রশাসনের কাছ থেকে অপ্রতুল সাহায্যের বাইরে চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো সহায়তা যে তারা পাবে না- এটিও তারা এখন বুঝে গেছে। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার স্থানীয় মানুষের এই ত্যাগী মানসিকতার সুযোগ নিচ্ছে।
এ লেখাটি যখন লিখছি তখন বৃহত্তর সিলেটেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। মাত্র দু’ বছর আগে ২০২২ সালে বৃহত্তর সিলেট স্মরণাতীতকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছিল। সেই ক্ষত সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। সিলেটে বন্যা খুব নিয়মিত হতো এমন নয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে বন্যার আঘাতে সিলেট বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এবারও ভারতের চেরাপুঞ্জি, শিলং থেকে বিপুল পানি নেমে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে সিলেটকে। প্রশাসনের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, উজানে বেশি বৃষ্টি হলে পানি আসবেই। এরকম তো পাহাড়ী ঢল আগেও হয়েছে। কিন্তু আগের সেই ঢলের সঙ্গে এবারের পার্থক্য কিছু রয়েছে। আগে পানি আসত, আবার সুরমা নদী হয়ে সেসব ভাটিতে চলেও যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেমনটা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেটে একটা সময়ে অনেক খাল বিল পুকুর ছিল। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে সেসব ভরাট করে ফেলা হয়েছে। সুরমা নদীর তলদেশে নানা ময়লা, আবর্জনা, পলিথিন ইত্যাদি জমেছে। ফলে এই নদীর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। নদীকে নদীর মতো চলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই একটু পানি হলেই নদীর দু’পাড় উপচে পড়ছে।
রাজধানী ঢাকা বা অন্য সব জেলার মতোই সিলেটেও বেশ কিছু লোভী মানুষ নিজেদের স্বার্থে জলাধারগুলো দখল করছে, ধ্বংস করছে। কিন্তু এ ধরনের স্বার্থপর ও পরিবেশ বিরোধী মানুষগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনের যে দায়িত্ব ছিল তারা তা পালন করেনি। বরং অনেকক্ষেত্রেই তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল প্রায় চারটি মেয়াদ জুড়ে দায়িত্ব পালন করছে। স্থানীয় নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের সিংহভাগই সরকারি দলের। এত দীর্ঘ সময় এবং এতটা প্রতাপ নিয়ে ক্ষমতায় থাকার পরও জনগণের ভোগান্তি হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়াটা দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নদী, খাল বিল ভরাটের যত ঘটনা আছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তার অনেকগুলোর পেছনেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা প্রশাসনের যোগসাজশ থাকার অভিযোগ রয়েছে।
বিগত বেশ কয়েকটি ঝড় বিশেষ করে যেগুলো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট অঞ্চলের ওপর দিয়ে গেলো- এ ঝড়গুলোর পরের দিন অনেক পত্রিকার হেডলাইন হয়েছে, ‘বুক পেতে দিয়েছে সুন্দরন।’ এসব সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে, অনেক বড়ো বড়ো ঝড়, সাইক্লোনকে প্রতিরোধ করেছে আমাদের সুন্দরবন। কেননা, সুন্দরবনের ঘন গাছগুলো ঝড়ের গতিকে অনেকটাই দুর্বল করে দিয়েছে। কিন্তু মর্মান্তিক বাস্তবতা হলো, মানুষের অত্যাচারে সুন্দরবনও এখন ক্লান্ত, দুর্বল ও অনেকটাই রুগ্ন। পাহাড় কাটা, নদী ভরাট করা এবং গাছ কেটে বন উজাড় করে দেওয়া- এ তিনটি সমস্যা আমরা নিয়মিতভাবে দেখে চলেছি কিন্তু এর কোনো প্রতিকার করা হচ্ছে না। প্রকৃতির বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে আমাদের অনাচার বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে এবং তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, প্রশাসনের তরফ থেকে এসব দৃশ্যমান সংকটগুলো নিরসন করার জন্য তেমন কোনো কার্যকরি উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটি করুণ বাস্তবতা হলো, সরকারি বা বিরোধী দল- উভয় দলের ক্ষেত্রেই প্রদর্শনেচ্ছা অস্বাভাবিক রকম বেড়েছে। দুর্গত এলাকাগুলোতে সাহায্য যেটুকু নেয়া হয় সে তুলনায় ত্রাণ বিতরণ নাটকেই যেন বেশি আগ্রহ দেখা যায়। সীমিত পরিসরের ত্রাণ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারণার কারণে অনেকক্ষেত্রেই দুর্গত মানুষগুলোর প্রকৃত সমস্যাগুলো আলোচনার বাইরেই থেকে যায়।
প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দল, সংগঠন ও সংস্থা এবং সর্বোপরি নাগরিকদের মধ্যে বিবেক ও মানবিকতা জাগ্রত হোক।