উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বাজেট সহায়তার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে থাকে। পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ২০১৭ সালের শেষে বাংলাদেশের সার্বিক মোট ঋণ ছিল ৫১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এসে ১০০ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। ইআরডির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫৬৩ কোটি ডলার ঋণ করেছে। বড় অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ যে ঋণ নিচ্ছে তার পরিমাণ মাত্র সাত বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা বারবার বাংলাদেশকে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করছেন।
বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি
দেশের অর্থনীতির নানা সঙ্কটের মধ্যে এখন অন্যতম হলো ঋণের পরিমাণ। বর্তমানের ১০০ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে ৭৯ বিলিয়ন ডলার সরকারের, যা জিডিপির ১৭ শতাংশের কাছাকাছি। উল্লেখ্য, আমরা উন্নয়নের জন্য যে অর্থ খরচ করেছি তার প্রায় পুরোটাই ঋণ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েসহ আমাদের রাস্তাঘাট সবই তো ঋণের টাকায় করা। ঋণ নেয়ার পরিমাণ এবং এর পরিশোধ দুটোই ক্রমাগত বাড়ছে। ঋণ পরিশোধের জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে সেটি চার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যদিও এই অনুপাত তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে খুব চাপ নয় তবে পরিশোধ করার পরিমাণটা সুদ এবং আসল মিলিয়ে অনেক বেশি। এই ঋণের ৫৭ ভাগ হলো বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছে। আর বাকি ৪৩ ভাগ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ঋণ যার বেশির ভাগ এসেছে জাপান, রাশিয়া, চীন ও ভারত দেশ থেকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, হঠাৎ করেই আমরা ঋণ ডাবল করে ফেললাম। হয়তো আগামী পাঁচ-সাত বছরে এটিও ডাবল হয়ে যেতে পারে যদি আমরা ম্যানেজমেন্ট ঠিক না রাখি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ঋণ এতটা বৃদ্ধির কারণ, বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না উল্টো বিদেশে অর্থপাচার, উচ্চশিক্ষা ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন ডলারের বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, যেটি দুশ্চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশে বাস্তবতা হলো, বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ব্যয় বৃদ্ধি। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতে বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা রয়েছে সরকারের কাঁধে। সেই সাথে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যয় আরো বেড়েছে টাকার অঙ্কে। টাকার অঙ্কে কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণও প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে।
ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক কি
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতের তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি এখনো গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে। জিডিপির অনুপাতে দেশী-বিদেশী ঋণের হার এখনো ৩৫ শতাংশের নিচে। আইএমএফের হিসাবে, এই হার ৫৫ শতাংশের নিচে থাকলে তা নিরাপদ। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, জিডিপির সাথে নয়, সরকারের রাজস্ব আদায়ের সাথে ঋণ পরিস্থিতির তুলনা করতে হবে। সে অনুপাতে বাংলাদেশের অবস্থা দুশ্চিন্তার। এর অন্যতম একটি কারণ তীব্র ডলার-সঙ্কট।
ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ
ঋণ নিয়ে চিন্তার মূল কারণ ঋণ পরিশোধের সময়। চীন, রাশিয়াসহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ শোধ করতে হয়, ফলে কিস্তির আকার বড় হয়। যেমন চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিলে গ্রেস পিরিয়ড বাদে পরবর্তী ১০ বছরে ঋণ ফেরত দিতে হলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে গড়ে ১০ কোটি ডলার। অন্য দিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ঋণ গ্রেস পিরিয়ড বাদে ৩০-৩২ বছরে পরিশোধ করতে হয়। ফলে চীনের একই পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে গড়ে তিন কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
বিদেশী ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের চাপে পড়ার অন্যতম কারণ হলো- এখন সরকার যে বিদেশী ঋণ নিচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুদ-আসলসহ ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে টাকার অঙ্কে ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা; অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ঋণ শোধের পরিমাণ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে সুদ পরিশোধ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঋণের বিপরীতে শুধু সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। ১০ বছর আগে বছরে যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করত, এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে তার দ্বিগুণের বেশি, যা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।
সূত্র মতে, যদি সরকার নতুন করে আর বিদেশী ঋণ না-ও নেয়, তারপরও সাত বছর পরে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হবে।
ঋণ পরিশোধে চ্যালেঞ্জের আরেকটি কারণ হলো, এসব ঋণে বাস্তবায়িত বড় প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি পাওয়া শুরু হয়নি। যেমন ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এতে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি চীনা ঋণ নেয়া হয়েছে। এই পথে এখন দিনে দু’টি ট্রেন চলাচল করে। অথচ তথ্য মতে, এই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের সবমিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। পরের বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধ বাড়তেই থাকবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়নি। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এক হাজার ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়া হচ্ছে। অধিকন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশী ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাচ্ছে। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এসব কারণে বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।
বিদেশী ঋণ পরিশোধের এই চাপ বাড়ছে এমন সময়ে, যখন দেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলার-সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। রিজার্ভ কমছে। প্রবাসী আয় কাক্সিক্ষত হারে আসছে না। রফতানি আয়ও আশানুরূপ নয়। লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।
ইআরডির তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে ৫৬৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। যেখানে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ৭২৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির ১৬১ কোটি পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ডলার গত ৯ মাসে ছাড় করেনি যা প্রতিশ্রুতির ২২.২৩ শতাংশ। অধিকন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুদে বা এখনকার চেয়ে বেশি সুদে বিদেশী ঋণ নিতে হবে। তাই স্নাতক হওয়ার আগেই স্বল্প সুদে বেশি ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল করা প্রয়োজন; কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে প্রতি বছরই ফেরত যাচ্ছে বিদেশী ঋণের অর্থ। ফলে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও বিতরণ বাড়ছে না।
এ দিকে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আয় বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে নিতে পারছে না। অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান বছর শেষে মুনাফা নিতে পারছে না। অন্য দিকে বড় বড় মেগা প্রকল্পের চলমান ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৩ বিলিয়নে।
উল্লেখ্য, দেশের বিদেশী ঋণের সমস্ত দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়ে। এরই মধ্যে মাথাপিছু ঋণ দেড় লাখ টাকার মতো, যা কিছু দিন আগেও এক লাখ টাকার মতো ছিল। সরকার অবশ্য জোর দিয়ে বলে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ঋণ নিয়ে আসছে এবং যথাসময়ে পরিশোধ করছে। বাংলাদেশ বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধে কখনো ব্যর্থ হয়নি।
তবে ঋণ পরিশোধে সরকারের পূর্ব সফলতা ধরে রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রার প্রবৃদ্ধি ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশে নামিয়ে ধরেছিল। সম্প্রতি তা সংশোধন করে মাত্র ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, আমদানি ব্যয় কমালে রফতানি আয়ও কমবে। কারণ পোশাক খাতে যে পরিমাণ রফতানি করা হয়, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আবার কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়। উৎপাদন কমে গেলে সরাসরি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। সব দিক বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনীতি ভবিষ্যতে আরো চাপে পড়তে পারে।
এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য কৌশলগত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতি ধরে রাখতে রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। দেশের কাঠামোগত দুর্বলতা যে সেক্টরে রয়েছে সেসব সেক্টরে বিনিয়োগ করে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ করতে হবে। বিদেশী ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে সতর্ক হতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com