ঘূর্ণিঝড় রেমালের তা-বে অস্বাভাবিক জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের মিঠা পানির আধার লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। যার কারণে বন্যপ্রাণীদের জন্য চরমভাবে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে মিঠা পানির খোঁজে হরিণ ও বাঘসহ সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদের পার্শ্ববর্তী লোকালয়ে ঢুকে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী মানুষের হাতে বন্যপ্রাণীদের জীবনহানির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। টানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা পুরো সুন্দরবন লবণপানির নিচে ছিল। ফলে এবার বন্যপ্রাণীর মৃতের সংখ্যা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সাথে হুমকির মুখে পড়েছে বনের বাস্তুতন্ত্র। ‘ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় এই জলোচ্ছ্বাস ছিল নজিরবিহীন। এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন পানি আর কোনোদিন সুন্দরবনে হয়নি। সেইসঙ্গে ছিল প্রবল বাতাস ও বৃষ্টি। তাই যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছে বন সংশ্লিষ্টরা।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। কমে গেছে মিঠা পানির প্রবাহ। অতিরিক্ত লবণাক্ততা বদলে দিচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
বনবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের আওতায় সুন্দরবনের সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জ অবস্থিত। এর মধ্যে খুলনা রেঞ্জে ২৩টি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে ১৬টি ক্যাম্প রয়েছে। প্রতিটি ক্যাম্পেই মিঠা পানির আধার হিসেবে রয়েছে একটি করে পুকুর।
জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষকরা বলছেন, রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের ভেতরের স্বাদুপানির পুকুরগুলো লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। এতে সুন্দরবনে খাবার পানি সংকট বাড়বে। প্রাণীকুল ছাড়াও সুন্দরবনে কর্মরত জেলে-বাওয়ালী ও বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংকটে পড়বে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ও খাদ্যশৃংখল বিনষ্ট হবে। লোনাপানিতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলো দ্রুত সেচে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। সামনে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিরপানি দিয়ে ভরতে হবে। আপৎকালীন বিকল্প পানির ব্যবস্থা করতে হবে। রিমালের ধরণ ও প্রভাব অনেকটাই আইলা ও কিছুটা ফণী ও বুলবুলের মতো। সুন্দরবন দীর্ঘসময় জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে ছিল। এ কারণে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনতল। বনের নিচু স্তরের অণুজীব, উদ্ভিদ, প্রাণী ও ম্যানগ্রোভ বীজের বেশি ক্ষতি হয়েছে। উদ বা ভোঁদড়, বেজি, গুইসাপ, ব্যাঙসহ বহু সরীসৃপ প্রাণীর সমস্যা হবে। হরিণ ও বুনো শূকরদের মৃত্যু এবং দীর্ঘমেয়াদী নানা অসুখ হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বন্যপ্রাণীরাও মানসিক অস্থিরতার ভেতর থাকে উল্লেখ করে গবেষকরা বলেন, এটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্য কিছুদিন সুন্দরবনে বাণিজ্যিক পর্যটন বন্ধ রাখা দরকার। সর্বশেষ দুবাই জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক ক্ষয়ক্ষতি তহবিল গঠিত হয়েছে। রুমালের কারণে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই তহবিল কাজে লাগাতে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।
চুনকুড়ি গ্রামের জাবের আলী গাজী (৫০) জানান, জীবিকার প্রয়োজনে তিনি গত ৩০ বছর ধরে বনে যাচ্ছেন। বনের ভেতরে পুকুরের পানিই একমাত্র ভরসা। সুন্দরবনের বাঘ থেকে শুরুকরে সব প্রাণী এই পুকুরের পানি খায়। সম্প্রতি সেইসব পুকুরগুলো লোনা পানিতে ভেসে গেছে। এখন সূপেয় পানির চরম সংকট পড়বে। সুন্দরবনে গত ৪০ বছর ধরে মধু ও মাছ আহরণ করেন শ্যামনগরের চকবার গ্রামের কামরুল গাজী (৬০)। তিনি জানান, তাদের একটানা দুই-তিন সপ্তাহ বনের ভেতর থাকতে হয়। লোকালয় থেকে যে পানি সঙ্গে করে নিয়ে যান তাতে চার-পাঁচ দিনের কাজ চলে। পরের দিনগুলো চলে বনবিভাগের পুকুরের পানি দিয়ে। কিন্তু এবার খাবার পানি নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে।
সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা কেএম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, এই রেঞ্জের চারটি স্টেশন ও ১২টি টহল ফাঁড়িতে ১৬টি পুকুরই লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে। হলদেবুনিয়া ও কাচিকাটায় ভবনে ফাটল ধরেছে। সাতক্ষীরা রেঞ্জে ১৫টি ক্যাম্পে সুপেয় পানির পুকুরসহ প্রায় এক কোটি ছয় লাখ টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সুন্দরবন পশ্চিম) এবং প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মহসিন বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘসহ সকল বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানি পানে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য নতুন করে ৮০টি পুকুর পুন:খনন করা হয়েছিল।’টানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা পুরো সুন্দরবন লবণপানির নিচে থাকায় সে সব পুকুর গুলোতে ও লবণ পানি প্রবেশ করেছে। তবে আগামী জুন-জুলাইয়ে (বর্ষা মৌসুম) পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ার পর সুন্দরবনের লবণাক্ততা কমে যাবে। সেই ক্ষেত্রে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদের লোকালয়ে প্রবেশের খুব একটা আশঙ্কা থাকবে না।