দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান শুরুর প্রথম সাত দিনের মধ্যেই ১১টি ব্যাংকের ২৭টি অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি খালি করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। অ্যাকাউন্টগুলো বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্য এবং তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ছিল। অ্যাকাউন্টগুলোতে শত শত কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম।
দুদক কমিশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের ফ্রিজ (অবরুদ্ধকরণ) আদেশ দেওয়ার এক মাস আগেই গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এসব অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা উত্তোলন করা হয়।
দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দুদক সূত্র জানায়, জমি কেনা এবং বিক্রি করা ছিল বেনজীর আহমেদের নেশা। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ জমি কেনে বেনজীর ও তার পরিবার। অধিকাংশ জমিই ২০২১ ও ২০২২ সালে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজনের নামেও কেনা হয় অনেক জমি। তবে সেসব জমি কেনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তার অবৈধ সম্পদের বৈধতা দেওয়া। কম মূল্যে জমি কিনে তা বেশি মূল্যে বিক্রি দেখিয়ে ট্যাক্স ফাইলে দেখানো অস্বাভাবিক লাভের বৈধতা দেওয়া।
সূত্র জানায়, রাজধানীর পূর্বাচল উপশহর ঘেঁষে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন আলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ।
স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও নামে-বেনামে নাগরীর পাশের চান্দখোলা মৌজার বেতুয়ারটেক গ্রামে কিনেছেন বিঘার পর বিঘা জমি। কালীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সম্প্রতি দুদক তল্লাশি চালিয়ে বেনজীর ও তার স্ত্রী এবং বড় মেয়ের নামে পাঁচটি দলিল পেয়েছে। চান্দখোলায় বেনজীর পরিবারের ৫০ বিঘার বেশি জমি ছিল। তবে এসব জমি ২০২১-২২ সালে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই জমি ছাড়াও আরো অনেক জমি বেনজীর ওই দুই বছরে বিক্রি করে দিয়েছেন।
ফলে ওই সব জমি দুদক আর ক্রোক করার সুযোগ পায়নি।
গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল দৈনিক কালের কণ্ঠে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই বেনজীর আহমেদ বিভিন্ন ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন। এরপর দুদক অনুসন্ধান শুরু করার প্রথম সপ্তাহে তিনি ১১টি ব্যাংকের ২৭টি অ্যাকাউন্টের সব টাকা উত্তোলন করেন। অ্যাকাউন্টগুলো হলো সিটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার তিনটি অ্যাকাউন্ট, কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশের চারটি, আইএফআইসি ব্যাংকের দুটি, দি প্রিমিয়ার ব্যাংকের তিনটি, ইউনিয়ন ব্যাংকের দুটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের দুটি, সিটি ব্যাংকের চারটি ও সোনালী ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্ট। এ ছাড়া একটি করে অ্যাকাউন্ট আইবিবিএলএ, এবি ব্যাংক এবং প্রাইম ব্যাংকে।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুসন্ধান টিমকে সার্বিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে যা যা করা দরকার, টিম তার সবগুলোই করবে। আমরা শুধু দেশের সম্পদই নয়, বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করছি।’
এদিকে দেশের সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই বেনজীর পরিবারের বিদেশে থাকা সম্পদ অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে তাদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসবের খোঁজও নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে কমিশনের অনুসন্ধান টিম বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। এরই মধ্যে আদালতের আদেশে বেনজীর পরিবারের মালিকানাধীন রাজধানীর গুলশানে বিশালাকৃতির বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জে ৩৪৫ বিঘা ও মাদারীপুরে ২৭৩ বিঘা জমি জব্দ এবং অসংখ্য ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেছে দুদক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বেনজীর, তার বেশির ভাগই তিনি কেনেন আইজিপি পদে আধিষ্ঠিত হওয়ার পর। তিনি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাকরিজীবনের শেষ দুই বছরে অর্থাৎ আইজিপি থাকাকালেই পরিবারের সদস্যদের নামে ৪৬৬ বিঘা জমি কেনেন বেনজীর। ১৯টি প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তার পরিবার হয়ে যায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিবার। আইজিপি পদটি যেন তার কাছে হয়ে ওঠে ‘আলাদীনের চেরাগ’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্ত্রীর ও সন্তানদের মৎস্য ব্যবসা দেখিয়ে আয়কর নথিতে অনেক অর্থ-সম্পদ দেখিয়েছেন বেনজীর। কর দিয়ে বিপুল সম্পদ আয়কর নথিতে দেখালেও এসব সম্পদের উৎসের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আর বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে তথ্য দিতে বিএফআইইউতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সোর্সের মাধ্যমে কমিশনের অনুসন্ধান টিম সিঙ্গাপুর, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় থাকা অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে।’
বেনজীরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বসহকারে আমলে নিচ্ছে দুদক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তার বিরুদ্ধে নানা তথ্য দুদকে আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের অনুসন্ধান টিম দেশের সব মিডিয়ায় প্রকাশিত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে।
ওই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক ভুক্তভোগী দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ধীরে ধীরে বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা আরো ভারী হচ্ছে।
বেনজীরকে পরিবারসহ দুদকে তলব
গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেয় দুদক। অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। চিঠিতে আগামী ৬ জুন বেনজীর আহমেদ এবং ৯ জুন তার স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। তবে আরেক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি।
বেনজীরের ক্রোক ও ফ্রিজ হওয়া সম্পদ
গত ২৪ মে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), ক্রেডিট কার্ড চারটি ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের মধ্যে। আদালতের আদেশের পর এরই মধ্যে ক্রোক ও ফ্রিজ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফা মিলিয়ে আদালত বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। তার নামে প্রায় ৫১২ দশমিক ৫৭ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক। বাকি ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে বেনজীর, তার দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর এবং বেনজীর আহমেদের স্বাক্ষরে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর ও জনৈক আবু সাঈদ মো. খালেদের নামে। নতুন করে যে ২৭৬ বিঘা জমি পাওয়া গেছে, তার পুরোটাই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। জমিগুলো মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়। ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে এসব জমি কেনা হয়। দলিল মূল্য দেখানো হয় মোট ১০ কোটি ২২ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতি শতাংশের দাম পড়েছে গড়ে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। বিঘা পড়েছে তিন লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এর আগে খোঁজ পাওয়া ৩৪৫ বিঘা জমির দলিল মূল্য দেখানো হয়েছিল প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে, ২০২৩ সালের ৫ মার্চ গুলশান সবরেজিস্ট্রি অফিসে চারটি দলিলে ৯ হাজার ১৯২ দশমিক ৭৮ স্কয়ার ফিট (বর্গফুট) ফ্ল্যাট ক্রয় করে বেনজীর আহমেদের পরিবার। এর মধ্যে দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার কোথাও এই দামে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) বরাত দিয়ে গত বছর দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব জানায়, রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম সবচেয়ে বেশি গুলশানে, প্রতি বর্গফুট ১৬৬ মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে ১৯ হাজার ৪২২ টাকার সমান।
বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে
কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২১ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
পরদিন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানান। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী ও জয়নাল আবেদীন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।
https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/06/02/1393762