রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা লিখেছি। ভবিষ্যতেও ইনশাআল্লাহ লিখবো। কিন্তু এরমধ্যে অর্থনৈতিক ফ্রন্ট থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে সেই খবরগুলো রীতিমত ভয়াবহ। আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। তন্মধ্যে যারা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তারা রয়েছেন কেউ আমেরিকা, কেউ ইংল্যান্ড, কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ সুইডেন সহ বেশ কয়েকটি দেশে। ২৯ ও ৩০ মে যথাক্রমে বুধ ও বৃহস্পতিবার আমি লন্ডন, স্টকহোম, সিডনি এবং এ্যারিজোনা থেকে কয়েকটি ফোন পেলাম। ফোনে তো নিয়মিতই কথা হয়। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ইত্যাদি কুশল বিনিময় হয়। কিন্তু ২৯ ও ৩০ মের ফোনগুলো ছিল ভিন্ন ধরনের। যারা ফোন করেছিল তারা সকলেই উদ্বেগের সাথে জানতে চাইল যে, বাংলাদেশে এখন হচ্ছেটা কী? তারা ওখানে ইন্টারনেটে পড়েছে আনোয়ারুল আজীম এমপির নৃশংস খুনের কথা, পড়েছে জেনারেল আজিজের স্যাংশন খাওয়ার কথা, পড়েছে বেনজিরের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের কথা। কিন্তু এগুলোর চেয়েও তাদের উদ্বেগ দেখলাম দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে। তারা অনেকগুলো খবর জানালো যেগুলো আমাদের দেশের প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আসেনি। তবুও সেগুলো তথ্যসমৃদ্ধ। আমি সেগুলো উল্লেখ করছি না একারণে যে, সেগুলো আমাদের দেশের প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হয়নি। কিন্তু তারা একথাও জানালো যে, বাংলাদেশ বিভিন্ন সূত্র থেকে যেসব ঋণ নিয়েছে অথবা যেসব জায়গা থেকে বাকিতে পণ্যসামগ্রী ইত্যাদি এনেছে এখন সেগুলো পরিশোধের জন্য নাকি আমাদের সরকারের ওপর ঐ পাওনাদাররা চাপ দেওয়া শুরু করেছে।
তাদের ফোন পাওয়ার পর আমি ৩০ মের ইংরেজি ডেইলি নিউ এজে চোখ বুলালাম। সেখানে লেখা হয়েছে যে, ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ আনা হয়েছে সেই বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করার জন্য আদানি গ্রুপ নাকি চাপ দিচ্ছে। এজন্য আদানি এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেডের ডাইরেক্টর প্রণব আদানি অর্থমন্ত্রীর সাথে সচিবালয়ে তার সাথে দেখা করেন। তারা যখন বেরিয়ে যান তখন আদানি গ্রুপ থেকে বলা হয় যে, বাংলাদেশে আরো অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগের বিষয়ে তারা আলোচনা করেছেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মাহমুদ আলী বলেন যে, আদানিদের কিছু বিল পেমেন্ট বাকি রয়েছে। এগুলো আমরা শীঘ্রই পরিশোধ করবো।
অনুসন্ধানে জানা গেল যে, ভারতের বিভিন্ন কোম্পানী থেকে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যে বিদ্যুৎ এনেছে তার মূল্য ৫ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এই তথ্য দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, গত ৭ মে পার্লামেন্টে। গত মার্চ মাস পর্যন্ত দেশী এবং বিদেশী কোম্পানীগুলো বিদ্যুৎ বিল বাবদ বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের কাছ থেকে ৩৩ হাজার ১০৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশ আদানির কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। আদানি গ্রুপের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, ঝাড়খন্ডে তারা ১৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে সক্ষম যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে সেটি বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করার জন্যই করা হয়েছে। আদানির সাথে চুক্তি হয়েছে যে, আগামী ২৫ বছর পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, আদানির বিদ্যুৎ যেমন দামে অনেক বেশি তেমনি তারা মুনাফাও অর্জন করছে বিরাট।
আদানিরা বাংলাদেশে শুধুমাত্র বিদ্যুৎই রপ্তানি করছে না। তারা সিঙ্গাপুরের উইলিয়াম ইন্টারন্যাশনালের সাথে মিলে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল নামক কারখানা থেকে রূপচান্দা, ফরচুন প্রভৃতি ব্র্যান্ড নামের সয়াবিন তেল বাংলাদেশে বিক্রি করছে। কিন্তু বাংলাদেশ এসব আমদানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না। কারণ তাদের হাতে প্রয়োজনীয় ডলার নেই। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু কয়েক দিন আগে যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন তিনি জানতে চান যে, বাংলাদেশে যেসব মার্কিন কোম্পানী কাজ করছে তারা তাদের আয় বা মুনফা কবে স্বদেশে প্রেরণ করতে পারবে?
॥ দুই ॥
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসেছিল আমার কাছে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ডে বসবাসকারী এক আত্মীয়ের নিকট থেকে। সে জানতে চাইল যে, ২০২১ সালের আগস্ট মাসেও আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ৪ হাজার ৮ শত কোটি মার্কিন ডলার। গত ১৫ মে বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হলো ১৮ বিলিয়ন ডলার। তার প্রশ্ন, বিগত ২০ মাসে ৩০ বিলিয়ন অর্থাৎ ৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মত বিশাল পরিমাণ ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ গেল কোথায়? তাদের যুক্তি, এই ২০ মাস ধরে সরকার তো কেবল খরচই করেনি, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্টস রপ্তানি বাবদ বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ আয়ও করেছে। তাহলে এই ৩০ বিলিয়নের খবর কী? আসলে এই খরচের খাতওয়ারি হিসাব সরকারও দিতে পারবে না। সন্দেহ করা হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে মস্ত বড় ঘাপলা রয়েছে। সেকারণেই তারা সাংবাদিকদেরকে সেখানে ঢুকতে দিচ্ছে না।
বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সত্যিই বেহাল দশা। অস্ট্রেলিয়া থেকে যে সেব ফোন পেলাম তার মাধ্যমে বোঝা গেল যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিশেষ করে ইকনোমিক ফ্রন্ট নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, যেভাবে অর্থনৈতিক ফ্রন্টে কাজ কারবার চলছে তার ফলে বাংলাদেশ যেন শ্রীলঙ্কার পথে না যায়।
কথায় বলে, সমুদ্র ঝড়ে জাহাজ ডুবির উপক্রম হলে জাহাজের বিভিন্ন কোণে লুকিয়ে থাকা প্রাণীরা নাকি সাগরে ঝাঁপ দেয়। বাংলাদেশেও দেখছি ঐরকম একটি দশা। অন্যদের কথা বাদই দিলাম। ডক্টর মইনুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি যে আওয়ামী ঘরানার সে কথা সকলেই জানেন এবং তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে অনেক কলাম লিখেছেন। সেই ড. মইনুল ইসলামও সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলোকে শে^তহস্তি বলছেন।
সেই ড. মইনুল ইসলাম একটি ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, বলা হচ্ছে যে ২০২৫ সালে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে রূপপুর প্রকল্প থেকে। এই প্রকল্পটি নির্মাণ করছে রাশিয়া। এ ব্যাপারে রাশিয়ার ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণসহ মোট খরচ হবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলছেন যে, অথচ সেই রাশিয়াই ভারতে ২ হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে দিয়েছে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ প্রায় একই পরিমাণ ক্যাপাসিটি বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়া বাংলাদেশের নিকট থেকে নিচ্ছে ভারতীয় প্রকল্পের তুলনায় ডাবল অর্থ। ড. মইনুল ইসলাম বলছেন যে, অন্য যেকোনো সূত্র থেকে ২৪ মেগাওয়াট ক্যাপাসিটির বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি কোনোক্রমেই লাগার কথা নয়। ড. মইনুল ইসলামের কাছ থেকেই আমরা জেনেছি যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখন ১০০ বিলিয়ন ডলার। ইতোমধ্যেই সরকার ঋণের সুদ পরিশোধ করতে শুরু করেছে। ২০২৬ সাল থেকে ঋণ সুদের (Debt Servicing) পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় মেগা প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নকে তিনি একদিকে বিলাসী এবং অন্যদিকে আত্মঘাতী বলে বর্ণনা করেছেন। দ্রুত অধপতিত ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ দেখে এই অর্থনীতিবিদ সুপারিশ করেছেন যে, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ৮ লেনের মহাসড়ক প্রকল্প অবিলম্বে বাদ দেওয়া হোক। চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেলপথ প্রকল্পও তিনি পরিত্যাগ করতে বলেছেন।
॥ তিন ॥
যতই দিন যাচ্ছে ততই মনে হয় প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হচ্ছে। সাবেক আইজি বেনজিরের লুটপাট সম্পর্কে পত্র পত্রিকাগুলো এখন সরগরম। এরই মধ্যে গত ৩০ মের পত্র পত্রিকাগুলোর প্রধান সংবাদ ছিল এই যে, বেনজিরের ৩৩ টি এ্যাকাউন্ট জব্দ বা ফ্রিজ করার আগেই তিনি তার এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়েছেন। এখন তার ব্যাংক এ্যাকাউন্টগুলো নাকি ফাঁকা। ৩০ মের নিউ এজের প্রথম পৃষ্ঠার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে যখন থেকে বেনজিরের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবিতে মিডিয়া মুখর, সেই সময়ে বেনজির তার বিভিন্ন ব্যাংক এ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ কোটি টাকা সরিয়েছেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা বেনজির এবং সাবেক সেনা প্রধান আজিজ আহমেদকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন। কিন্তু ৩১ মে একটি মেইনস্ট্রিম পত্রিকা বলে পরিচিত বাংলা দৈনিকে রিপোর্ট করা হয়েছে যে, বেনজির নাকি গত ৪ মে সপরিবারে বিদেশ বেড়াতে গেছেন। খবরটি যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বিস্মিত হবো না। কারণ কালের কণ্ঠে রিপোর্টটি বেরিয়েছে গত ৩১ মার্চ। তার সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দেওয়া হয়েছে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। এত লম্বা সময় দিলে যা হয় এখানেও তাই হয়েছে। চিড়িয়া উড়ে গেছে (যদি ঐ রিপোর্টটি সত্য হয়)।
অবস্থা দেখে শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ধনিক গোষ্ঠীর অবাধ লুটপাটের চারণভূমিতে। ৩১ মের দৈনিক সমকালে বলা হয়েছে যে, মালয়েশিয়ায় জনবল রপ্তানি বাবদ কয়েক জন আওয়ামী নেতাকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। এই সিন্ডিকেটের পকেটে চলে গেছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন, ৩০ মের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদ মোতাবেক, লে: জে: (অব) মাসুদুদ্দিন চৌধুরীর কোম্পানীর ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল। অন্যেরা হলেন ফেনী-২ আওয়ামী এমপি নিজাম হাজারির ¯িœগ্ধা ওভারসিজ, বেনজির আহমেদ নামক আওয়ামী লীগের আরেক জন এমপির আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল, সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের (লোটাস কামাল) স্ত্রীর এবং মেয়ের অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ।
॥ চার ॥
জেনারেল আজিজের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা আজ আর বললাম না। তবে অনেকেই মনে করেছিলেন যে, এটি হলো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ঘোষিত ভিসা নীতির অধীনে স্যাংশন দেওয়া হয়েছে। না, তা দেওয়া হয়নি। তাকে দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত কঠোর একটি আইনে। এটি হলো এন্টি ক্লেপ্টোক্র্যাসি ও এন্টি হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন শীর্ষক আইনের অধীনে। এই আইনে আছে যে, যেসব দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে যদি কোনো ব্যক্তিকে স্যাংশনের আওতায় আনা হয় তাহলে যারা অপরাধীকে সাহায্য করেছেন অথবা দেখেও না দেখার ভান করেছেন তারাও এই অপকর্মের দায় এড়াতে পারেন না।
রাজনৈতিক ফ্রন্টে আছে ইন এ্যাকশন, স্থবিরতা এবং ভীরুতা। কিন্তু অর্থনৈতিক ফ্রন্টে যেসব অপকর্ম চলছে সেগুলোকে ক্লেপ্টোক্র্যাসি আইনে চুরিবিদ্যা (Thievery) বলা হয়েছে। এই চৌর্যবৃত্তির দায় সরকারও এড়াতে পারে না।
Email: asifarsalan15@gmail.com