কোনো আগন্তুক, এ জনপদের যেকোনো নাগরিককে যদি প্রশ্ন করেন- বাংলাদেশ এখন কেমন চলছে, আর কোনটি এ দেশের বড় সমস্যা। সে নাগরিক রসিকতা করে যদি বলেন, সারা অঙ্গে ঘা, মলম দেবো কোথা! আগন্তুকের কাছে উত্তরটি হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হলেও এ কথায় সারবত্তা আছে। আসলে তিনি রসিকতাচ্ছলে এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশের পূর্ব-পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে, ভূ-তলে-ভূ-পৃষ্ঠে, ঊর্ধ্বলোকে সর্বত্র বহু সমস্যা। কোথায় সমস্যা নেই, সেটিই বরং প্রশ্ন হতে পারে। অতি শোকে মানুষ পাথর হয় বলে প্রবাদ আছে। অবশ্যই এই বাক্য শোকের সমার্থক হিসেবে বিবেচিত। আর এই পানি-কাদার দেশে মানুষ তার দুর্ভাগ্য নিয়েও কখনো কখনো রসিকতা করে বলেন, এই বিধিলিপি তারই হাতে আঁকা। বলে কপালে ভাঁজ ফেলে অপেক্ষা করেন। নীরব থাকেন, কাদামাটির মতো গলে যান। আবার কখনো কখনো সময়ের ব্যবধানে চৈত্র মাসের মাটির মতো পাথরের মতো হয়ে ওঠেন। এখন কাদামাটি থেকে পাথুরে মাটি হয়ে ওঠার জন্য খুব বেশি সময় হয়তো আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। এমন বাক্যাবলি এখন বাতাসে ঘুরছে। যাই হোক, মূল কথায় ফিরে যাই। দেশে এখন এন্তার সমস্যা। সব নিয়ে বললে বা লিখলে সেটি হয়ে উঠবে ‘বিষাদ সিন্ধু’র মতো বিপুল বপুর। এত জায়গা কি কোনো দৈনিকের থাকে। সমস্যার কোনো একটি বেছে নেয়া হলে কথা হতে পারে।
এ দিকে আবার ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে বিড়াল বা বনবিড়ালও নয়- একেবারে আস্ত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। একটি নয় দু’টি নয়। হয়তো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। একে একে সময়-সুযোগে বেরিয়ে আসবে। এসব বাঘ-বিড়ালের বেরিয়ে পড়ার নানা চমকপ্রদ কাহিনী দেশের মানুষ শুনছে। তবে তারা খুব একটা অবাকও হচ্ছে না। মানুষ অনেক আগে থেকে বুঝতে পারছিল, ঝোলার ভেতর অনেক বাঘ-বিড়াল লুকিয়ে আছে। ওসবের নড়াচড়া মানুষ দিব্যি টের পাচ্ছিল। হিসাবের কোনো গণ্ডগোল হয়ে গেছে। এসব নিয়ে অনেক লেখাজোখা, বলা কওয়া এখন চলছে। এতকাল সব শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা ছিল। হঠাৎ কিভাবে কোন জাদুর বলে সব বের হলো এবং আরো হয়তো হবে।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে আসি। উপরে বলা হয়েছে, সারা গায়ে ঘা, মলম দেবো কোথায়। প্রকৃত অর্থে এ জনপদের কোথায় এখন সমস্যা নেই? এই প্রশ্নেরই কোনো উত্তর নেই। এখানে কদমে, কদমে সমস্যার যত খনি। হররোজ সংবাদপত্রের পাতায় শত নয়, হাজারো সমস্যা একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদে আর লুটিয়ে পড়ে। কোনটি ছেড়ে কোনটি নিয়ে কথা বলা যায় তা নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। প্রতিদিন দুর্ভোগ-দুরাচার, অত্যাচার-অবিচার নিয়ে যত সমাচার প্রকাশ পাচ্ছে তা পাঠ করলে চিন্তাচেতনায় বৈকল্য সৃষ্টি হবেই। এতে যে চিত্ত-চাঞ্চল্যের কারণ হবে সেটি মানুষকে বোধহীন এক যন্ত্রে পরিণত করতে চলেছে। এটি এখন কোনো আশঙ্কা নয়, নিরেট বাস্তবতা। আবারো উল্লেøখ করা যেতে পারে। পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রতিদিন প্রকাশ পায় তার শতভাগ না হলেও বেশির ভাগই দুঃসংবাদ। গত ২৯ মে প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে যত সংবাদ ছাপা হয়েছে তার অন্যতম নারী নির্যাতনকেন্দ্রিক। এ ছাড়া রয়েছে দুর্নীতি-দুরাচার, অনিয়ম-অব্যবস্থা, লুণ্ঠন-অসম বণ্টন, আরো বহু অঘটনের যত সমাহার। দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এখন যত কথা সবাইকে বারবার শুনতে হচ্ছে তাতে কর্ণদূষণের আশঙ্কা শতভাগ। এর পাশাপাশি ঠিক নারী নির্যাতনের সমসংখ্যক দুঃসংবাদ পত্রিকায় পাতায় থাকছেই। এখন এমন একটি ধারণা তৈরির চেষ্টা বিরামহীন চলছে যে, এ দেশের নারী নাগরিকরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠছেন। প্রকৃত সত্যটি কি তাই? নারীদের এখানে প্রতিদিন সবচেয়ে দুর্বল আর অসহায় মানুষে পরিণত করা হচ্ছে এই জনপদে। তার প্রমাণ পত্রিকায় পাওয়া যায়। নারীর মর্যাদা এখন ভেঙে ভেঙে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। নারী ভোগের পণ্যে পরিণত হচ্ছে। তারই প্রতিনিধি হচ্ছে শিলাস্তি।
সবাই জানেন, শিলাস্তি টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসেছিল জীবনযুদ্ধের নায়িকা হতে; কিন্তু সমাজবাস্তবতা (তথা নারীর সম্মাননা দিতে যে পরিবেশ দরকার তা অনুকূল ছিল না) তাকে বাধ্য করেছে ‘প্রতিনায়িকা’ হতে। এ জন্য তার পরিপার্শ্বিকতা অনেকখানি দায়ী হলেও শিলাস্তিকেও স্বয়ং নায়িকা থেকে ‘প্রতিনায়িকা’ হয়ে ওঠার জন্য অনেক দায় বহন করতে হবে। পিচ্ছিল পথে হাঁটতে হলে যে সাবধানতা অবলম্বন করতে হতো সেটি হয়তো সে আত্মস্থ করতে পারেনি বা চেষ্টা করেনি। অথচ সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক ছিল। সেখানেও ওই অনুশীলন সে করেনি। এই ভুল তাকে তার জীবনের বাকি সময় না ভুগিয়ে রেহাই দেবে না। সে কাঁদবে, স্বজনরা পরিতাপ করবে। কিন্তু যা হবার হয়েই গেছে।
যাই হোক, এ দেশের সমাজ সংসার নিয়ে অধিকাংশ মানুষ তৃপ্ত হয় না। এখন সমাজের অনেকেই ভুলে গেছেন নারী প্রতিটি জাতির ও সমাজের মা। তার আগে সে ছিল গৃহের সৌন্দর্য সংহতির বধূ, তারও আগে সে ছিল স্নেহের কন্যা। নারীর এমন রূপান্তরের সাথে সাথে একেক পর্যায়ে তার সম্মান মর্যাদা স্নেহ মমতার অপরূপ বিন্যাস ঘটে।
কিন্তু আজ এ দেশে নারী সবচেয়ে ভাগ্যহীনা আর দুর্বল। প্রতিদিনের পত্রিকায় নারীকে অসম্মানিত করার যেসব খবরের কথা বলা হয়েছে, তেমনি একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে- ধর্ষণের শিকার তরুণীর অপমানে আত্মহত্যা। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ধর্ষণের শিকার এক তরুণী বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। অভিযুক্ত ধর্ষক কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে মেয়েটিকে মারধর করে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দেয়ায় তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। … মেয়েটির পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ‘মানিকপুর গ্রামের মৃত মোসলেম মিয়ার মেয়ে মর্জিনা বেগম (৩০) রূপগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। একপর্যায়ে বিশনন্দী চালারচর গ্রামের জহিরুল রায়হানের (৩৬) সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গত বছরের আগস্টে জহিরুল তাকে বিয়ে করার কথা বলে কৌশলে আড়াইহাজার পৌরসভার বাজারে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে।… পরে জহিরুলের বিরুদ্ধে মেয়েটি বাদি হয়ে থানায় ধর্ষণের মামলা করেন। পুলিশ তাকে (জহিরুল) গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠালে ছয় মাস কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে মেয়েটিকে প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। এরপর জহিরুল ও তার বাবা মেয়েটিকে মারধর করে। এরপর রাগে দুঃখে মেয়েটি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করে। এমন ঘটনা নতুন নয়। দেশের সবখানে এমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু প্রতিনিয়ত ঘটছে। বিনা দ্বিধায় বলা যায়, এখন এটাই দেশের চালচিত্র। দেশের অবলা নারীদের এমনই যত গল্প সবখানে। দেশের বহু মেয়ে প্রতারকের আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে এভাবেই আত্মাহুতি দিচ্ছে। আরেকটা কথা- বিচারব্যবস্থা শুধু কি আইনের সুতার ওপর হাঁটা। চিন্তাবিবেচনা সমাজবাস্তবতার কথা কি ভাববে না। প্রতারকরা আইনের সুযোগ নিয়েই হাজারো নারীর শুধু সর্বনাশ নয়, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার আয়োজন করে বিনা দ্বিধায় পরম স্বস্তিতে থাকার জন্য। এর কি কোনো প্রতিবিধান হবার নয়। এমনই করুণ পরিণতি হয়েছিল কুমিল্লার কন্যা অবন্তিকার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান শাসকদলের অনুগামী ছাত্রলীগের এক নেতা এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ও ‘শিক্ষক’ মিলেমিশে অবন্তিকাকে যৌন হয়রানি করছিল অবিরত। তাদের দু’জনার যৌথ হয়রানি সহ্য করতে না পেরে সেই দুঃখী মেয়ে জীবন দিয়ে জীবন জুড়ালো।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নির্বাহীদের দায়িত্বের কোনো শেষ নেই। তারা প্রতি মুহূর্ত ব্যতিব্যস্ত থাকেন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে। তাদের দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় দুর্বল দুস্থদের সেবা দেয়ার মতো বিষয়গুলোই। তাদের উচিত স্পর্শকাতর সংবেদনশীল বিষয়গুলোর সমাধানে কালক্ষেপণ না করা; নারী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সমস্যাসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গভীর মনোযোগ দিয়ে বিচার-বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করা, যাতে সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহণকারীরা অনুভব করে, তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষ সংবেদনশীল। বাংলাদেশে নারীকে মর্যাদা দান এবং তাদের যথোপযুক্ত আসনে সমাসীন করার জন্য এটি জরুরি। আজও এ দেশে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত নারীরা সমাজ সংসার থেকে সম্মান লাভ করা থেকে পিছিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে তাদের পথযাত্রাকে আরো কঠিন করে তোলা হচ্ছে। নারীসমাজকে পদে পদে অসম্মানিত করার অসম প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব বিচারে সমাজ রাষ্ট্রের দায়ভার অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
আর ব্যর্থ হবে না কেন! দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতার ‘ওম’ এখন বড় আকর্ষণ। সেখানে নীতিনৈতিকতার চর্চা অনুশীলন আশা করা একেবারেই হাস্যকর। কিন্তু উচ্চতর বিদ্যাপীঠে নীতিনৈতিকতার অনুশীলন হবে এটাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত। অথচ এখন সেখানে গর্বভরে ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’ করার কথা উচ্চারিত হয়। সেসব সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কিছু শিক্ষক, যারা সেখানে জ্ঞানবিদ্যার চর্চা, নীতিনৈতিকতার অনুশীলন বাদ দিয়ে ছাত্রীদের যৌন হয়রানিতে অভ্যস্ত-আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখন দেশে ‘অবলা দুর্বল’ নারীর জন্য সম্মানপ্রাপ্তির আশা যতটা বেশি করা হবে, ঠিক ততটাই মানুষকে প্রতারিত হতে হবে।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা অবশ্যই নারীকে অনেক কিছু পেতে উৎসাহিত করবে সন্দেহ নেই। তবে এটা অভিযোগ নয় উপলব্ধি। নারী এখন যা আশা করে তার চেয়ে বেশি আশ্বাস পায় বটে। কিন্তু এখানে কি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার মতো কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে। এ দেশের সামগ্রিক হাল অবস্থা যে স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে, সেখান থেকে কোনো নাগরিকের সুরক্ষা লাভের কোনো সম্ভাবনা কি আছে? নারীও সেই একই রকম নাগরিক। তাহলে তার আর কোনো পৃথক সুরক্ষা থাকতে পারে? এখন সব ওলট-পালট হবার পথে। কার সুরক্ষা কে নিশ্চিত করবে এটাই বিবেচনার বিষয়।
ndigantababar@gmail.com