মুসলমানদের জীবনে বড় একটা স্বপ্ন থাকে একবার পবিত্র হজ পালন করা। এজন্য অনেকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কিছু কিছু অর্থ সঞ্চয় করেন।
এই সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তারা আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ যেতে চান। কিন্তু তাদের সেই চাওয়ার জায়গাটা মসৃণ নয়। নানা ধরনের চার্জ ও ভ্যাটের কারণে প্রতিবছর হজযাত্রীদের খরচ শুধু বাড়তেই থাকে। ফলে অনেকে নিয়ত করেও আল্লাহ ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না।
চলতি মৌসুমে একজন হজযাত্রীর মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশই চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ভ্যাট ও বিভিন্ন চার্জের পেছনে। টাকার অঙ্কে যা ৯০ হাজার।
এর মধ্যে দেশে ভ্যাট ও বিভিন্ন চার্জে গুনতে হয় ৩৪ হাজার টাকা। আর ৫৬ হাজার টাকার বেশি বাড়তি ব্যয় হয় সৌদিতে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে একজন ব্যক্তির হজের প্যাকেজ ৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। তবে ভ্যাট ও চার্জের অংশ বাদ দেওয়া গেলে প্যাকেজের আকার নেমে আসবে ৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকায়। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হজে যেতে আরও উৎসাহী হবেন।
এদিকে হজ ফ্লাইট চালুর পর থেকে গত ২৩ দিনে ৫৫ হাজার ১৩২ জন হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছেছেন। তিনটি বিমান সংস্থার মোট ১৪১টি ফ্লাইটে এসব যাত্রীরা ঢাকা ত্যাগ করেন। গত ৯ মে প্রথম হজ ফ্লাইট চালু হয়। ১২ জুন সর্বশেষ হজ ফ্লাইট সৌদি আরব যাবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৬ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
চলতি বছর সৌদি আরবের চুক্তি অনুযায়ী ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একাধিকবার নিবন্ধনের সময় বৃদ্ধি করেও কোটা পূরণ করতে পারেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়। এবার সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৪ হাজার ৪৯০ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গাইডসহ ৮০ হাজার ৬৯৫ জন হজে যাচ্ছেন।
এতে বাংলাদেশ থেকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে মোট ৮৫ হাজার ১৮৫ জন হজ পালনে সৌদি আরব যাচ্ছেন। সে অনুযায়ী এবারও ৪২ হাজার কোটা পূরণ করতে পারেনি, যা শতকরা হিসাবে ৩৩ শতাংশ কোটা পূরণ হয়নি।
হজযাত্রীদের ওপর আর্থিক চাপ কমানোর বিষয়ে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম যুগান্তরকে বলেন, ভ্যাট প্রত্যাহারের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সৌদি সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে। হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া কমানোর ব্যাপারে আমরা দীর্ঘদিন দাবি করে আসছি।
হাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ওমরা গমনে ট্রানজিট বিমান ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ বিমানের সরাসরি ফ্লাইটে ৮০-৮৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। ডলারের কারণে দাম ওঠানামা করে।
যদিও ২০২২ সালে হজের সময় প্রত্যেক হজযাত্রীর কাছ থেকে বিমান ভাড়া ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছিল। গত দুই বছর ধরে বিমান ভাড়া অনেক বেড়েছে। এবার হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী প্রতি হজযাত্রীর বিমান ভাড়া বেড়েছে ৫৫ হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এক্ষেত্রে সরকার চাইলে সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করে হজযাত্রীদের জন্য সব বিমান সংস্থা উন্মুক্ত করে দিতে পারে। এতে যাত্রী বহনে প্রতিযোগিতা চলে আসবে। বহনকারী সংস্থা বেশি হলে ভাড়া এমনিতেই কমে আসবে।
হজ ব্যবস্থপনা পোর্টাল সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ৮১ হাজার ৪২৯ জন হজযাত্রী প্রাক-নিবন্ধন করেও চূড়ান্ত নিবন্ধন করেনি। অথচ অন্যান্য বছর হজে যাওয়ার জন্য ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ নিবন্ধন করে হজযাত্রীরা অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকেন।
এছাড়া গত বছরের আগে আবেদনের সংখ্যা এত বেশি ছিল, যে কেউ হজে যেতে চাইলে দুই থেকে তিন বছর আগে প্রাক-নিবন্ধন করতে হতো। এখন হজ প্যাকেজের অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি করায় প্রাক নিবন্ধন করেও চূড়ান্ত নিবন্ধনে আগ্রহ দেখান না অনেক হজযাত্রী।
জানা যায়, নিজ দেশ ও সৌদি আরবে বড় অঙ্কের ভ্যাট পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন হাজিরা। এবছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে গমনেচ্ছু প্রত্যেক যাত্রীর সর্বনিম্ন হজ প্যাকেজে সৌদি আরবে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৩ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এর মধ্যে সৌদি সরকারকে বাড়ি ভাড়া ও অন্যান্য খরচে ভ্যাট পরিশোধ করতে হচ্ছে ৫৬ হাজার ৩৪৮ টাকা।
এদিকে চলতি মৌসুমে বিমান ভাড়া ধরা হয় ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে নিট বিমান ভাড়া ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ভাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাট ও অন্যান্য ফি ধরা হয় ১২ হাজার ১৮৬ টাকা। এজেন্ট কমিশন ফি দিতে হচ্ছে ২ হাজার ৭৭৫ টাকা।
শুধু বিমান ভাড়ায় প্রতি হজযাত্রীকে প্রায় ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট ও অন্যান্য ফি দিতে হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক হজযাত্রীর আইডি কার্ড ও লাগেজ ট্যাগ বাবদ ৮০০ টাকা ও কল্যাণ তহবিল ২০০ টাকা, প্রশিক্ষণ ফি ৪০০ টাকা, খাওয়া খরচ বাবদ ৩৫ হাজার টাকা, হজ গাইড বাবদ ১৩ হাজার ৫৩ টাকা দিতে হয়েছে। এতে করে প্রত্যেক হাজিকে হজে যেতে ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ বাবদ বাংলাদেশেই পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা। দুই দেশে মোট ভ্যাট ও অন্যান্য খরচ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৯০ হাজার টাকা।
এছাড়া সরকার সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করে হজযাত্রীদের জন্য সব বিমান সংস্থা উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন হজযাত্রীরা। তারা মনে করেন, এতে বিমান ভাড়া অনেক কমে আসবে। আরও অনেকেই হজে যেতে আগ্রহী হবেন। নির্ধারিত কোটাও পূরণ হবে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, হজ পালনে দুই দেশের ভ্যাট ও অন্যান্য চার্জ বাবদ যে খরচ হয় সেটি আমাদের একার পক্ষে কমানোর কোন সুযোগ নেই। তবে যারা ভ্যাট নেয় (রাজস্ব ও ভ্যাট বিভাগ) তাদেরই এই উদ্যোগ নিতে হবে বলে জানান তিনি।
চলতি হজ মৌসুমে সর্বনিম্ন সরকারি প্যাকেজে খরচ পড়ছে ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকার মতো। এর বাইরেও হজযাত্রীদের নানা খরচ আছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সর্বনিম্ন প্যাকেজে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
প্যাকেজের বাইরে ব্যক্তিগত কেনাকাটা করতে আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হয়। হজযাত্রীদের অভিযোগ, বেসরকারিভাবে নির্ধারিত হজ প্যাকেজে ঘোষণা করলেও এই টাকায় কেউ চূড়ান্ত নিবন্ধন করতে পারেনি। হজযাত্রীদের আরও বাড়তি দামে এই নিবন্ধন করতে হয়েছে।