কেউ জমি বন্ধক রেখে, কেউ গরু বিক্রি করে মালয়েশিয়া যাওয়ার টাকা জমা দিয়েছিলেন। কেউ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন ব্যাংকঋণ নিয়ে। কেউবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করেছিলেন। মালয়েশিয়া গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা ফেরাবেন, এই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দেশটিতে যেতে না পেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাঁদের। হতাশা নিয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গতকাল শনিবার ফিরে গেছেন কয়েক হাজার মানুষ।
শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরে আসা এসব মানুষ রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, কোম্পানিকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা দিয়েও মালয়েশিয়ায় যেতে পারলেন না। তাঁদের কেউ বিমানের টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারেননি। অনেকে তিন গুণ বেশি দামে টিকিট কিনেও ওই দেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে কাজের অনুমতিপত্র না পেয়ে যেতে পারেননি।
তবে এত তাড়াহুড়া করেও অনেকেই বেশি দামে উড়োজাহাজের টিকিট কিনে দেশটিতে গেছেন। সেখানে গিয়েও যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় কেউ কেউ সেখানকার বিমানবন্দরে আটকা পড়েন।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সংকট তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া হবে না।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী
মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সে দেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল ৩১ মে, শুক্রবার। কর্মী ভিসায় শুক্রবারের পর আপাতত আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারবেন না। তাই শুক্রবার ঢাকা বিমানবন্দরে হাজারো মানুষের ভিড় দেখা যায়।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সংকট তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ছাড় দেওয়া হবে না।
এসব সমস্যা সমাধানে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আশা করছি যে বা যারা এই সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করা হবে।’
প্রক্রিয়া শেষ করার পরও কত শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তার একটি হিসাব বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপর প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।
বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী
কত শ্রমিক যেতে পারেননি হিসাব নেই
উড়োজাহাজের টিকিট না পেয়ে ঠিক কতজন আটকে গেছেন, তার হিসাব নেই সরকারি সংস্থার কাছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রাও এর হিসাব দিতে পারছে না।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রক্রিয়া শেষ করার পরও কত শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তার একটি হিসাব বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপর প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে।
তবে ভিসা ও অনুমোদন জটিলতায় ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী আটকা পড়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দায়িত্বশীল সূত্র। তাঁরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এবার শ্রমবাজার চালুর পর মালয়েশিয়া যেতে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন কর্মীর অনুমোদন নেয় ১০১টি এজেন্সি। এর মধ্যে সব কর্মীর জন্য মালয়েশিয়া থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যায়নি। তাই বিএমইটি থেকে শেষ পর্যন্ত সব এজেন্সি মিলে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ কর্মীর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মী গড়ে খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শেষ দিকে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এ খরচ আরও বেড়েছে। তবে যাঁরা ছাড়পত্র নিতে পারেননি, তাঁরাও উড়োজাহাজের টিকিটের দাম ছাড়া বাকি টাকা এজেন্সিকে দিয়েছেন। তার মানে ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী কয়েক লাখ টাকা করে দিয়ে রেখেছেন।
এর বাইরে আরও অনেক কর্মী মালয়েশিয়া যেতে টাকা জমা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শ্রমবাজার চালু থাকার সময় অনেকেই বিদেশে যেতে প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো পাসপোর্ট করে এজেন্সির কাছে জমা দিয়েছেন। কেউ কেউ পাসপোর্ট, মেডিকেল করেছেন। এরা সবাই এজেন্সি বা দালালের মাধ্যমে কিছু কিছু করে টাকা দিয়ে রেখেছেন। এসব টাকার কোনো মানি রসিদও থাকে না। বিদেশ গমনেচ্ছু এমন কর্মীর সঠিক সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব কারও কাছে নেই।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সব মিলে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর সংখ্যা ৪০ হাজারের মতো হতে পারে। কর্মীর জমা দেওয়া টাকার শতভাগ এজেন্সির ফেরত দেওয়া উচিত। আরা যাঁরা দালালকে টাকা দিয়েছেন, তাঁদের টাকা উদ্ধারেও সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে।
চক্র তৈরি করে কর্মী পাঠানোয় অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষে খোলা হয় বাজারটি। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র গড়েছিল। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। তখন আবারও চক্র সৃষ্টি করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, দেশটি আপাতত আর বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিক নেবে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মালয়েশিয়া যেতে একজন কর্মী গড়ে খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শেষ দিকে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এ খরচ আরও বেড়েছে।
তাঁদের আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না
নাটোরের সিংড়া এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমানের শেষ সম্বল ছিল ১৬ শতাংশ জমি ও চারটি গরু। এক বছর আগে এক লাখ টাকায় সেই জমিটুকু বন্ধক রাখেন। সাড়ে চার লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন গরুগুলো। হাবিব জমি ও গরু বিক্রির সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন ঢাকার পল্টন এলাকার একটি এজেন্সিকে।
চার দিন আগে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন হাবিবুর। মালয়েশিয়া যেতে না পেরে গতকাল বিমানবন্দরের কাছে একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছেন তিনি।
যাঁরা ছাড়পত্র নিতে পারেননি, তাঁরাও উড়োজাহাজের টিকিটের দাম ছাড়া বাকি টাকা এজেন্সিকে দিয়েছেন। তার মানে ৩১ হাজার ৩০৪ জন কর্মী কয়েক লাখ টাকা করে দিয়ে রেখেছেন।
হাবিবুর রহমানের সঙ্গে গতকাল দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানির লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাঁরা অন্য দেশ দিয়ে মালয়েশিয়ায় পাঠাবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু সেখানে তো আর লোক নেবে না। তাহলে কীভাবে আমাকে পাঠাবে বুঝতে পারছি না।’
হাবিবুর রহমানের মতো অনেকেই বলছেন, যে কোম্পানিকে (রিক্রুটিং এজেন্সি) তাঁরা টাকা দিয়েছিলেন, তাঁদের এখন আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের অফিসে গিয়েও বন্ধ পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে তৃণমূল অভিবাসীদের সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, টাকা দিয়েও এতগুলো লোক যেতে পারেনি, এর দায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে নিতে হবে। ক্ষতিপূরণসহ মূল টাকা ফেরত দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।