বেনজীর আহমেদ। বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক। ছিলেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হিসেবেও। তার চলাফেরা ছিল রাজসিক। কথাবার্তায় ছিল ক্ষমতার দাপট। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার হিসেবে বিরোধী দল ও হেফাজতের আন্দোলন দমিয়ে আলোচনায় আসেন বেনজীর। এরপর র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশ প্রধান হিসেবে তার বিভিন্ন উদ্যোগ ও বক্তব্য আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে সরকারি দলকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। শুধু বিরোধী দল নয়, তার ক্ষমতার দাপটে তটস্থ ছিলেন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও।
বিভিন্ন সময়ে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ। যেটি করতে গিয়ে করেছেন অসংখ্য বেফাঁস মন্তব্য।
২০১৩ সালের ২৮শে জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ কেন্দ্রীয় হাসপাতালে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে গিয়ে তিনি শিবির দেখলেই গুলি করতে বলে সমালোচিত হয়েছিলেন। হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন কনস্টেবল মোকলেছুর রহমান (কং: ৭১৪৭) এর খোঁজখবর নেয়ার সময় তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, অস্ত্র ছিল না, গুলি করতে পারোনি? এখন থেকে শিবির দেখামাত্র গুলি করবা। এরপর চার নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন পায়ে আঘাত পাওয়া কনস্টেবল জিয়াউরকে (কং: ২৭২৯) উদ্দেশ্য করে বলেন, পায়ের আঘাত সুস্থ হলে ওদের পা ভেঙে দেবা। যদিও পরবর্তীতে শিবির দেখলেই গুলির নির্দেশনার কথা অস্বীকার করেন। ৩রা ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন এ ধরনের নির্দেশ বা বক্তব্য আমি দেইনি। যারা এ সংবাদ প্রচার করেছেন, তাদের জিজ্ঞেস করুন। জামায়াত-শিবির যদি তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করে তাদের দ্বারা কোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত না হয়, তাহলে পুলিশ তাতে বাধা দেবে না। সহিংস কোনো ঘটনা না ঘটালে তারা পুলিশি নিরাপত্তা পাবে।
২০১৩ সালের ৫ই মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি পণ্ড করতে ভূমিকা রাখে ঢাকা মহানগর পুলিশ। সে সময় ডিএমপি কমিশনার হিসেবে হেফাজতে ইসলামের প্রতি নিজের কঠোর অবস্থানের জানান দেন বেনজীর। শুরুতে হেফাজত বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের অনুমতি চায়। ডিএমপি সেখানে অনুমতি না দিয়ে বিকাল পাঁচটার মধ্যে সভা শেষ করার শর্তে শাপলা চত্বরে অনুমতি দেয়। কিন্তু হেফাজত নেতারা নির্ধারিত সময় পর ১৩ দফা দাবিতে শাপলা চত্বরে অবস্থানের ঘোষণা দেন। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গভীর রাতে ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ শুরু করে পুলিশ। যাতে নেতৃত্ব দেন বেনজীর। ওই অপারেশনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠে। যদিও হেফাজতের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার কয়েকদিন পরে বেনজীর বলেন, এ অভিযানে ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সম্মিলিতভাবে অংশ নেয়। এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল, কোনো রকম প্রাণহানি ছাড়া হেফাজতকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়া। এ অভিযানে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গ্রেনেড, স্মোক গ্রেনেড এবং রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কোনো প্রাণহানি হয় না। সারা দুনিয়ায় পুলিশ এসব ব্যবহার করে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের আগে ও পরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সেই সময় বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিরোধে শক্ত ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। সহিংসতায় অনেকে মারাও গিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বিএনপি’র মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি ঠেকাতেও কঠোর ভূমিকা নিয়েছিল পুলিশ। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। যেটি পরবর্তীতে ‘বালুর ট্রাক থেরাপি’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। বিএনপি নেতারা এ ঘটনার জন্য তখনকার ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়ে সমাবেশ ও কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি দেয় বিএনপি। সেবারও বালুর ট্রাক এনে খালেদা জিয়ার অফিসের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
বেনজীর আহমেদ র্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় বাহিনীটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠে। কিন্তু বেনজীর সেসব হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলতে নারাজ ছিলেন। ২০১৫ সালের ২৬শে জানুয়ারি তিনি বলেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একটি সস্তা প্রচারণা। একটি বিশেষ মহল এই প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত। অপরাধীরা অপরাধ করবে আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা চেয়ে চেয়ে দেখবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কি অস্ত্র দেয়া হয়েছে হা-ডু-ডু খেলার জন্য? ২০১৮ সালের ১৮ই মার্চ একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ একটি ভুল শব্দ।
২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দেয়া বক্তব্যে বেনজীর আহমেদ বলেন, ২০৪১ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া অলিক কোনো চিন্তা বা স্বপ্ন নয় এটা বাস্তব। সে বাস্তবতা বাস্তবায়নের জন্য আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করতে চাই। জঙ্গি, মাদক ও দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস নেই। কাউকে ভয় পাবেন না। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করবো। এরা বিদায় হবে আমরা থাকবো।
১৩ই এপ্রিল ২০২০ সালে তিনি বলেছিলেন, রিলিফ ও ওএমএসের চাল নিয়ে কোনো রকম নয়ছয় আমরা করতে দেবো না। এটি কোনোক্রমেই সহ্য করা হবে না। আপনারা আমাদের তথ্য দেবেন আমরা তাৎক্ষণিক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তাদের এক সভায় তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা, সংবিধান, রাষ্ট্র ও জাতির জনক- নোবডি ক্যান টাচ দেম। ২০২১ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি বেনজীর আহমেদ বলেন, বন্দুকযুদ্ধ হলে কি আমাদের লোকজন বন্দুক ফেলে পালিয়ে চলে আসবে?
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিও গ্রহণ করার কথাও প্রচার করতেন বেনজীর। ২০২১ সালের ১৪ই জুন নবীন এসআইদের এক অনুষ্ঠানে বেনজীর আহমেদ বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি বলবৎ করতে হবে। আমি চাই তোমরা এ তেরশ’ সদস্য বাংলাদেশ পুলিশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করবে। তিনি বলেন, জাতীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রের স্বার্থের কাছে কখনো ব্যক্তি স্বার্থকে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। ব্যক্তি স্বার্থকে পিছে ফেলে আমাদেরকে জনগণ, দেশ ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থানে ধারণ করতে হবে। পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশ পুলিশকে এ দেশের মানুষের প্রথম ভরসাস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩০শে মে ২০২২ সালে তিনি বলেছিলেন, নেভার আন্ডারস্টিমেড দ্য পাওয়ার অব দ্য গর্ভনমেন্ট অ্যান্ড পাওয়ার অব দ্য পিপল। জনগণ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা যারা অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখায় তারা আহম্মক। জনগণ ও রাষ্ট্রের কাছে এসব অপশক্তি অতি তুচ্ছ।
১৯৮৮ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেয়া বেনজীর আহমেদকে কেউ কেউ মনে করেন স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি। যার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ। যদিও তিনি নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার’ মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সম্পৃক্ততার জন্য।
বেনজীর আহমেদ চাকরিতে থাকা অবস্থায় শুদ্ধাচার পদকও পেয়েছিলেন। কিন্তু অবসরে যাওয়ার পর তার অবৈধ সম্পদের নানা তথ্য আসতে থাকে। এসব অবৈধ সম্পদের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা হওয়ায় তার অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। প্রাথমিক তদন্তের পর বেনজীর, তার স্ত্রী ও সন্তানের নামে থাকা ৬২১ বিঘা জমি, গুলশানের ৪টি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক ও ৩টি বিও অ্যাকাউন্ট ক্রোক ও জব্দ করতে আদালতে আবেদন করে দুদক। এই আবেদনে আদালত বেনজীরের সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেন। যদিও বলা হচ্ছে সম্পদ জব্দ প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এমনটা টের পেয়ে গত মাসের শুরুর দিকে পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়েন বেনজীর। আলোচনা আছে দেশের মতো বিদেশেও বেনজীর অনেক সম্পদ গড়েছেন। তবে এসব সম্পদের কোনো তথ্য এখনো দুর্নীতি দমন কমিশন জানতে পারেনি। বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে জানতে তিনটি দেশে দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।