চোখে-মুখে হতাশা। বিষণ্ন রাকিবুল হাসান। মাথা নিচু করে বসেছিলেন। তার পাশে রাখা লাগেজ, ব্যাগ। মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে এসেছিলেন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কিন্তু বিমানের টিকিট না পেয়ে স্বপ্ন পরিণত হয় হতাশায়। শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় কথা হয় রাকিবুলের সঙ্গে। তিনি জানান, মালয়েশিয়া যেতে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন দালালকে। এক বছর ধরেই মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে ঘুরাচ্ছিল দালাল। শেষে শুক্রবার সন্ধ্যার ফ্লাইটে পাঠানোর কথা জানায়।
এ জন্য রাকিবুলকে বিমানের একটি ভুয়া টিকিট ধরিয়ে দেয় দালাল। রাকিবুল বলেন, শুক্রবারও ১ লাখ ২২ হাজার টাকা দিয়েছি। দালাল ফোনে টিকিট পাঠাইছে। কিন্তু এটা ভুয়া। বলছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ফ্লাইটে যেতে পারবো। কিন্তু যেতে পারিনি। পরে দালাল আবার বলছে সাড়ে ১১টায় ফ্লাইটের টিকিট দিবে। এখন সেই সময়ও পার হয়েছে। আমাদের বার বার ঘুরাইছে। এখন আবার বলছে, আজ হবে না। আজ না হলে কবে হবে। আজকের পর তো আর যেতে পারবো না।
রাকিবুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তা দিয়ে টেনেটুনে ৫ সদস্যের পরিবার চালান তিনি। বিদেশ যেতে না পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বলেন, এখন সর্বস্বান্ত হয়েছি। সুদের উপর ৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। আর বাকি যা ছিল তা সারাজীবন একটু একটু করে জমিয়েছি। ছোট দুই ভাইয়ের লেখাপড়া কীভাবে চালাবো, সামনের দিনইবা কীভাবে চলবো জানি না। এখন মন চাইছে ট্রাকের নিচে মাথা দিয়ে মারা যাই।
শুধু রাকিবুল নন, শুক্রবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মতো ৫ হাজারের বেশি কর্মী মালয়েশিয়া যেতে না পেরে হতাশ হয়ে ফিরেছেন। সরজমিন বিমানবন্দরে দেখা যায়, এদিন সকাল থেকেই মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা লাগেজ, ব্যাগ নিয়ে বিমানবন্দরে অবস্থান করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে তাদের উপস্থিতি। রাত ৭টা পর্যন্ত কয়েক হাজার কর্মী বিমানবন্দরের সামনে অবস্থান নেন। এদিন মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের জন্য ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর রুটে একটি বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সেই ফ্লাইটে ২৭১ জন যেতে পারলেও টিকিট না পেয়ে বাকিরা যেতে পারেননি। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিমানবন্দর থেকে বিষণ্ন মুখে ফিরে যান এসব কর্মী। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরের ভাড়া সাধারণ সময়ে ২৫ হাজার টাকা। তবে এদিন বিশেষ অতিরিক্ত ফ্লাইটের ভাড়া জনপ্রতি ৭৩ হাজার ৬১৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ফ্লাইট সংকটে অনেকেই লক্ষাধিক টাকা দিয়েও পাননি কাক্সিক্ষত টিকিট। বিমানবন্দরে এদিন দালাল কিংবা রিক্রুটিং এজেন্সির দেয়া ‘আশ্বাসে’ অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। অনেকেই অভিযোগ করেন, টিকিট দেয়ার কথা বলে এক-দেড় লাখ টাকা নিয়ে রিক্রুটিং এজেন্টরা তাদের ফোনও ধরেননি। মালয়েশিয়াগামী এসব কর্মীর কেউ কেউ জমি-জমা বিক্রি করে, চড়া সুদে ধারদেনা করে কিংবা গয়না বন্ধক রেখেও টাকা দিয়েছিলেন।
শাহজাহান মুন্সীও তাদের একজন। রাত ১২টায় বিমানবন্দর টার্মিনালের সামনে বসেছিলেন। সাড়ে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দালালকে দিয়েছিলেন। তিনি জানান, যাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া যাওয়ার চুক্তি করেছেন তারা বিকালে কল দিয়ে শাহজাহানকে দ্রুত এয়ারপোর্টে আসতে বলেছেন। তিনি সন্ধ্যা থেকে বসে ছিলেন এয়ারপোর্টে। কিন্তু এরপর আর ফোন ধরেনি তারা। শাহজাহান বলেন, এখন ১২টা বাজে। মাত্র তাদের ফোন দিয়েছি। বললো, মালয়েশিয়া থেকে টিকিট দিবে। এটা কি কখনো সম্ভব নাকি। আমি কি মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ আসবো! এখন একটা প্যাঁচের মধ্যে পড়ে গেছি। মাথা কাজ করছে না। এখন তো আর কোনো ফ্লাইটও নাই। গোপালগঞ্জ জেলার মোকসেদপুর উপজেলায় বাড়ি তার। গ্রামে কৃষিকাজ করতেন। তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবার। মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে প্রবাসে কর্মসংস্থান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে না পেরে এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বলেন, পুরো টাকাই সুদে ধার করে নিয়েছি। এখন চিন্তা করছি, এই টাকা কীভাবে দেবো। কীভাবে মেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়বো।
তিনটা গরু বিক্রি করে আর ধারদেনা করে বিদেশ যেতে এজেন্সিকে টাকা দিয়েছিলেন রবিউল মোল্লা। নড়াইল থেকে তিন দিন ধরে ঢাকায় এসেছেন। রবিউলের ভাই লোকমান সিকদার বলেন, ঢাকায় এসে দালালের পেছন পেছন ঘুরছি। তারা হঠাৎ শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় বলে রাত ৮টার বিমানে মালয়েশিয়া পাঠাবে। কিন্তু ৮টায় ফ্লাইট হলে ৭টায় জানালে কীভাবে যাবো। তাও দ্রুত এয়ারপোর্টে আসছি। কিন্তু আসার পর আবার ফোন দিয়ে তারা বলছে, এখন যাওয়া যাবে না। তিন দিন পর টিকিট দিবে। কিন্তু তিন দিন পর কীভাবে দিবে। আর তো কোনো ফ্লাইট নাই।
বন্ধুকে নিয়ে লাগেজ ধরে টার্মিনালের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন ফয়সাল। তার চোখে-মুখেও চিন্তার ছাপ। ফয়সাল বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৩টায় টিকিট দিয়েছে। কিন্তু ফ্লাইট ছিল ৪টা ৪৫ মিনিটে। এত অল্প সময়ে সেই ফ্লাইট ধরতে পারি নাই। পরে যাদের মাধ্যমে কাগজ করিয়েছি তারা বললো এয়ারপোর্টে থাকতে। তারা আবার টিকিট দিবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর কোনো টিকিট দেয় নাই। যারা আমাদের সঙ্গে ছিল তারা সবাই ফিরে গেছে।
গত মার্চে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষণা করে ভিসা পাওয়া বিদেশি কর্মীদের ৩১শে মে’র মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে হবে। তবে এরমধ্যেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ফ্লাইট না থাকার কারণে হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে যেতে পারেননি। ফ্লাইট বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্মীদের প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির অনুরোধ করে। এতে সাড়া না দিয়ে গতকালই সব দেশের কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে মালয়েশিয়া।
বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও টিকিট না পাওয়ায় তিন থেকে চার হাজার বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি।