সিলেটে পানিবন্দি মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। খাদ্য সংকট তো চলছে, তার উপর বিশুদ্ধ পানির সংকটও তীব্র। খোদ সিলেট নগরেও বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যায় উজানের পানি নামছে। কিন্তু ঢলের তোড়ে রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় বহু স্থানে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। কানাইঘাট বাজারে পানি কমেছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩ শতাধিক দোকানপাট। হরিপুর-গাছবাড়ি সড়কের উপর এখনো দুই ফুট পানি। সিলেট-জকিঞ্জ সড়কে পানি থাকলেও যানবাহন চলাচল করতে পারছে। জেলায় ৭টি উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নে ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। ভেসে গেছে তাদের সর্বস্ব। চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তাদের। কবে পানি কমবে- এ অপেক্ষায় রয়েছেন ঘরবন্দি প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, উজানের ঢল কম নামছে। সুরমার চেয়ে কুশিয়ারায় পানি প্রবাহ বেশি। এ কারণে নদী তীরবর্তী এলাকায় বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। তিনি বলেন, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ থেকে পানি নামছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার বাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে এখনই বলা যাচ্ছে না উজানের ঢলে বাঁধের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ঢল থেকে বেঁচে যাওয়া বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন বলে জানান তিনি। সিলেটে দু’টি প্রধান নদী। একটি সুরমা ও অপরটি কুশিয়ারা। উজানের ঢল কম আসায় সুরমা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। কুশিয়ারা অববাহিকার তীরবর্তী জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলার ২৫ থেকে ৩০টি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। গোলাপগঞ্জের বাঘা, বুধবারী বাজারসহ ৪টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেলার আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৫ হাজার বন্যার্ত মানুষ রয়েছে। তাদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার্তদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৪০০ টন চাল, নগদ প্রায় ১৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
ইউএনও ও জনপ্রতিনিধিরা মিলে বন্যার্তদের মধ্যে এই অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। গোয়াইনঘাট থানার ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, নিম্নাঞ্চলে পানি রয়েছে। তবে যেসব রাস্তা ও বাঁধের অ্যাপ্রোচ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হবে। এদিকে- সিলেট নগরে পানি বেড়েছে। নতুন করে আরও ৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। নগরের সাদাটিকর, তেররতন, উপজেলা ই ও ডি ব্লক, সুবহানীঘাট, যতরপুর, মাছিমপুরসহ অন্তত ২০টি এলাকা পানির নিচে রয়েছে। নগরীর উপশহরে অর্ধেকের বেশি এলাকা তলিয়ে গেছে। তেররতন এলাকার মূল সড়কে কোমর পানি। কয়েকশ’ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তাদের জন্য কাউন্সিলর সুহিন আহমদ একটি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছেন। কুশিঘাট এলাকায় নতুন করে পানি ঢুকেছে। এ ছাড়া মাছিমপুর এলাকার ৫ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতেÑ সিলেট নগরে সুরমার পানি বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবারের চেয়ে শনিবার পানি বেড়েছে। নগরের উপশহরের বেশিরভাগ এলাকার বাসার নিচতলা তলিয়ে গেছে। আব্দুল শুকুর নামে ডি ব্লকের বাসিন্দা জানিয়েছেন, নিচতলায় থাকা বাসিন্দাদের আসবাবপত্র বন্যার ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেছেন। আবার কেউ কেউ দোতলা ও তিনতলায় অবস্থান নিয়েছেন। উপশহর এলাকায় গতকালও পানি বেড়েছে বলে জানান তিনি। ওই এলাকার ভাড়াটে সুমন আহমদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, পানি উঠে যাওয়ায় তারা রান্না করতে পারছেন না। শুকনো খাবার খেয়ে জীবন চালাচ্ছেন। সকালে হোটেল থেকে নাস্তা এনে খেয়েছেন।
গতকাল সকালে উপশহর এলাকার ডি ব্লক ঘুরে দেখা গেছে- নিচতলার অনেক বাসিন্দা আসবাবপত্র রেখে নগরের নিরাপদ এলাকার উঁচু স্থানের বাসাবাড়িতে চলে যাচ্ছেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের আশপাশের এলাকাও তলিয়ে গেছে। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে উপশহরের ই ব্লকসহ কয়েকটি এলাকা তলিয়ে যায়। ফলে শুক্রবার অনেক মানুষ পানিবন্দি ছিলেন। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলো পর্যাপ্ত নয়। উপশহরেরই বাসিন্দা সিলেট সিটি করপোরেশনের পিআরও সাজলু লস্কর। তার বাসার সামনের রাস্তায় পানি উঠেছে। তিনি জানিয়েছেন, পানিবন্দি মানুষের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের চাহিদামতো খাবার দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। নগরের সুবহানীঘাট, যতরপুর এলাকার মানুষ তিনদিন ধরে পানিবন্দি। নিচতলার অনেক বাসাবাড়ি পানির নিচে। সুবহানীঘাট এলাকার মতিন মিয়ার কলোনির বাসিন্দাদের দুপুরের দিকে দল বেঁধে দূরবর্তী স্থান থেকে পানি আনতে দেখা যায়। কেউ কোমরপানি, কেউ গলা পানি ডিঙিয়ে পানি নিয়ে আসছিলেন।
বৃদ্ধা ববিতা বেগম জানিয়েছেন, পানিতে ভাসছি, অথচ খাবার পানিরই সংকট বেশি। দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। মেন্দিবাগের গ্যাস ভবনের পেছনের পুরো এলাকা তলিয়ে গেছে। হাজারো পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। মেন্দিবাগ এলাকার জলিল আহমদ জানিয়েছেন, পানির নিচে আছি, কেউ এখনো এসে দেখেনি। খেয়ে না খেয়ে এলাকার মানুষ বসবাস করছেন। অথচ তাদের খোঁজ নিচ্ছেন না কেউ। সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, সিলেট সিটি করপোরেশনে গতকাল পর্যন্ত দুটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। নতুন করে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা না বাড়ার কারণে আর আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়নি। তবে পানিবন্দি মানুষ যাতে অভুক্ত না থাকেন সে কারণে মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর নির্দেশে আমরা সচেষ্ট রয়েছি। এখন বন্যার্ত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি মেডিকেল টিমও প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।