কয়েক হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তিন প্রভাবশালীকে খুঁজে পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা দেশ ছেড়েছেন। একসময় দোর্দ- প্রতাপশালী ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। স্মরণকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী সেই সাবেক আইজিপির দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বেনজির আহমেদ স্বপরিবারে দেশ ছেড়েছেন। বেনজির আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের দুর্নীতির দায়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের আগেই গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তার দেশ ছাড়ার বিষয়ে ঊর্ধতন মহলের কেউ কেউ অবগত আছেন বলেও জানা যায়। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে ১০ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগ ওঠা বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু এখন কোথায় আছেন সেটা জানে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়া ২০১৯ সালে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠা প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার বেনাপোল দিয়ে বিদেশ চলে যান। বর্তমানে তিনি কলকাতা কারাগারে আছেন। এখন প্রশ্ন উঠছে-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর এসব ব্যক্তির কিভাবে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশত্যাগ করেন? দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগগুলো তদন্ত শুরুর আগেই তারা কোন প্রভাবশালীর ইঙ্গিতে দেশ ছাড়েন? কে তাদের সহায়তা করে? পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টার পোলে রেড আ্যালার্ট দেয়া হলেও তাকে আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
স্ত্রীসহ বেনজীর আহমেদের দেশ ছাড়ার গুঞ্জন : আগামী ৬ জুন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তলব করা হয়েছে। আর ৯ জুন তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে ডেকেছে সংস্থাটি। দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই দিন বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়। তাছাড়া বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি এবং বেনজীরের পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন আদালত। বেনজীর পরিবারের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধ করার আদেশও দেওয়া হয়। সাভারে তাদের কিছু জমিও পড়েছে একই আদেশের মধ্যে। এরই মধ্যে সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, গত ১২ মে সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ দেশত্যাগ করেছেন। যদিও পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, বেনজীর আহমেদ ঢাকাতেই আছেন, আত্মগোপনে আছেন। তিনি তার গুলশানের বাড়িতে নেই, অন্য কোথাও আছেন। কিন্তু এই তথ্যের পিছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একাধিক কারণে বেনজীর আহমেদের দেশত্যাগের গুঞ্জন ক্রমশ শক্ত ভিত্তি পাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো কারণ হল যে, বেনজীর আহমেদ যদি দেশেই থাকতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিনি যোগাযোগ করতেন। তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে সাক্ষাৎকার দিতেন। আইনজীবীদের সাথে কথা বলতেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করতেন। কিন্তু এসব কিছুই তিনি করেননি এখন পর্যন্ত। এমনকি তার একান্ত ঘনিষ্ঠরা পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, এটি নিশ্চিত করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর অর্থ হল, তিনি দেশে নেই। একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, বেনজীর আহমেদ সম্ভবত দুবাইয়ে আছে।
দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাইবে দুদক : বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের অনুসন্ধান শুরুর তথ্য পেয়েই এই অর্থ সরিয়ে নেন বেনজীর আহমেদ। দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সরিয়ে নেওয়া এই টাকার পরিমাণ কয়েক শ কোটি হতে পারে। আর তা সরানো হয়েছে আদালতের আদেশে দুদক কর্তৃক বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার আগে। এদিকে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চাইবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জমি, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগের উৎস খুঁজতে তাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে শিগগিরই আদালতে আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের একজন কর্মকর্তা।
তুলে নিয়ে শেয়ার কেড়ে নেয়ার অভিযোগ : গভীর রাতে সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য (এমপি) শফিকুর রহমানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার লিখে নেয়ার অভিযোগ করা হয়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে। নাফিজ সরাফাত রাত ১টার দিকে সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমানকে বাসা থেকে বেনজীরের কাছে নিয়ে যান। বৃহস্পতিবার লিখিত বক্তব্যে এমন দাবি করেছেন শফিকুর রহমান এমপি। সিনিয়র সাংবাদিক মুহম্মদ শফিকুর রহমান চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি। তিনি ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ মেয়াদে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সরকারের অনুমোদন পায় স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভি। তবে এখনও এই টেলিভিশন সম্প্রচারে আসেনি। লিখিত বক্তব্যে মুহম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, আমি সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান (মালিক)। প্রথমদিকে আমার কোনো শেয়ারহোল্ডার ছিল না। একা অনএয়ারে আসার মতো টাকাও আমার ছিল না। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় রুট গ্রুপের মালিক রাজ্জাকুল হোসেন টুটুল অনুরোধ করেন, তাকে সঙ্গে নিলে অনএয়ারে আসার জন্য বাড়িভাড়া, অফিস স্টাফসহ ৩০-৪০ লাখ টাকা যা খরচ হয়, তিনি করবেন। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হই এবং তাকে সঙ্গে নিই। তবে আজকাল করে বছর চলে যায়। এরই মধ্যে সরকারের অন্যান্য যা অনুমোদন দরকার তা করে ফেলি। তিনি বলেন, হঠাৎ এক রাতে সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত নামে এক যুবক (আগে চিনতাম না) আমার বনানীর বাড়িতে আসেন। সিটিজেন টিভি স্পোর্টস দিয়ে শুরুর কথা বলে আমাকে তুলে নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলের নিচতলায় বেনজীরের কাছে নিয়ে যান। বেনজীর, নাফিজ সরাফাত, টুটুল ছাড়াও অচেনা চেহারার আরও দু’জন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যাদের দেখে মনে হলো সশস্ত্র। বেনজীর একটা হলুদ কাগজ আমার হাতে দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি কাগজের লেখা পড়তে শুরু করলে বেনজীর বাধা দিয়ে বলেন, সিটিজেন টিভি হবে স্পোর্টস ওরিয়েন্টেড। অচেনা দু’জনকে দেখিয়ে বলেন স্পোর্টসের লোক। তাদের সঙ্গে একটু চুক্তিতে আসতে হবে। এই কাগজ সেই চুক্তিপত্র। এক পর্যায়ে তারা ধমকের সুরে কথা বলেন। রাত ২টার দিকে আমি স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হই।
বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চু কোথায়? বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু কোথায় আছেন জানে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকার একটি আদালত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় ৫২টি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিয়েছেন। এর আগে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানায় দায়ের করা আরও দুটি মামলায় তার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়া হয়। মামলার নথি থেকে জানা যায়, শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় এবং তার বর্তমান বাসা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়। গত ৩০ এপ্রিল ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে বলা হয়, এক সপ্তাহ আগে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে, কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের কেউই ওই ঠিকানায় থাকেন না। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পল্টন থানায় দায়ের করা একটি দুর্নীতির মামলায় এ পরোয়ানা দেওয়া হয়। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, ‘এক হাজার টাকা কৃষিঋণের কারণে কেউ জেলে যায়, আর ১০ হাজার কোটি টাকা শিল্পঋণের খেলাপি গ্রাহক সরকারের পাশে বসে।’ বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৫৯টি মামলায় বাচ্চুকে আসামী করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২৯ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু কোথায় আছেন আমরা সত্যিই জানি না। আমরা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তার বাসায় অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু তাকে পাইনি।’ ‘তিনি বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ত্যাগ করেননি। তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদি কোনো বিমানবন্দর বা স্থলবন্দর দিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন, তাহলে আমরা জানতে পারব।
পিকে হালদার ভারতে : সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়া দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার হালদার গ্রেফতার হয়ে ভারতে আছেন। যিনি পিকে হালদার নামেই বেশি পরিচিত। ২০১৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগর থেকে তাকে গ্রেফতার করে দেশটির অর্থসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তবে পালিয়ে থাকা পিকে হালদার ভারতে গ্রেফতার হলেও অর্থ আত্মসাতের পেছনে থাকা তার গডফাদাররা এখনো অপ্রকাশ্যেই রয়েছেন। আর্থিক খাতের একজন শীর্ষ নির্বাহী হিসেবে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক এবং তার আগে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন পিকে হালদার। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ নিয়ে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকিয়ে পালিয়ে যায়। তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞায় দেয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের চিঠি ইমিগ্রেশন পুলিশ হাতে পাওয়ার দুইঘণ্টা নয় মিনিট আগেই পিকে হালদার বেনাপোল দিয়ে বিদেশ চলে যান।