দুর্নীতি যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা, উন্নয়ন ব্যাহত, সরকারকে অস্থিতিশীল ও গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করে বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার। মার্কিন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদকে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। চলতি সপ্তাহের গত মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে একজন সাংবাদিক এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করেন। এদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শৃঙ্খলাভঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ যেনো শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ না পায় সে বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে জাতিসংঘ। গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ত ডেথ স্কোয়াড র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) এর সদস্যদের শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োগ অব্যাহত থাকা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ নিয়ে জাতিসংঘ কতটুকু উদ্বিগ্ন জানতে চাইলে গত বৃহস্পতিবার এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে এ মন্তব্য করেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিভাগের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের লাক্রোয়ার। আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এই বিশেষ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। এদিকে গতকাল শুক্রবার ঢাকা বেশকয়টি গণমাধ্যমের সংবাদে বলছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। দেশে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের কথিত দুর্নীতি ও অপকর্মের জন্য সরকার দায়ী। সরকার তার দোসরদেরকে ছাড় দিলেও দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিষয়ে কোনো ছাড় দিবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। বর্তমান সময়ে তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকে এটা পরিষ্কার বুঝা যায়।
এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তলবের এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আগামী ৬ জুন তাদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। তাদের দুই মেয়ে হলেন ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। তবে আরেক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি। এছাড়াও দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় গত ২১ মে সোমবার (বাংলাদেশ সময় সোমবার মধ্যরাতের পর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার কারণে সাবেক জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদকে, পূর্বে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান, ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে পররাষ্ট্র দপ্তর। এর ফলে আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য হবেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তার (আজিজ আহমেদ) কর্মকা-ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশের সাবেক পুলিশপ্রধানের ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে। তার (বেনজীর আহমেদ) ওপর দুটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আপনি কি আমাদের বলতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে তার কোনো সম্পদ থাকার বিষয়টি মার্কিন কোনো সংস্থা জানতে পেরেছে কিনা এবং সম্পদ থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে তা জব্দ করেছে কিনা? একইভাবে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের বিষয়ে আপনারা কিছু পেয়েছেন কি না, যেহেতু সম্প্রতি তার ওপর আপনারা ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেন? এই ব্যক্তিরা অবাধে যেকোনো কিছু বা সবকিছু করার সুযোগ পাচ্ছেন, সে জন্য কি আপনারা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবেন? ম্যাথু মিলার বলেন, আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব, নতুন করে ঘোষণা দেওয়ার মতো কিছু আমার কাছে নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব, আপনি যেসব অভিযোগ ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা বললেন, সেসব বিষয় সম্পর্কে আমি অবগত। আমরা এটা স্পষ্ট বলে আসছি যে আমরা বিশ্বাস করি, দুর্নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাধা, উন্নয়ন ব্যাহত, সরকারকে অস্থিতিশীল এবং গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে। বর্তমান মার্কিন প্রশাসন শুরু থেকেই দুর্নীতি দমনকে একটি প্রধান জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ হিসেবে গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ে আমরা এই কৌশল কীভাবে বাস্তবায়ন করব, তা তুলে ধরেছি। কিন্ত নতুন করে ঘোষণা দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই। আপনিও জানেন, আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) কখনো নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কোনো পদক্ষেপ নিলে কখনো আগে থেকে সে সম্পর্কে কিছু জানাই না। ব্রিফিংয়ে ম্যাথু মিলারকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, জার্মানভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলে ও স্যুডডয়চে সাইটুং এবং সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-এর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের নিয়মিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে মোতায়েন করা হচ্ছে। যেহেতু মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাই এর কর্মকর্তাদের জাতিসংঘ মিশনগুলোতে মোতায়েন নিয়ে আপনি কতা উদ্বিগ্ন? কেননা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের তহবিলের প্রায় ২৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র দেয় তার করদাতাদের দেওয়া অর্থ থেকে। এর জবাবে ম্যাথু মিলার বলেন, আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) এসব প্রতিবেদনের বিষয়ে অবগত। শান্তিরক্ষা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এবং এটা আবশ্যক যে শান্তিরক্ষীরা মানবাধিকারের সুরক্ষা দেবেন। জাতিসংঘের নীতি অনুযায়ী, যেসব দেশ সেনা বা পুলিশ পাঠায়, সেসব দেশের ওপরই জাতিসংঘ নির্ভর করে যে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাবিষয়ক আইন লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সেনা বা পুলিশ সদস্যকে পাঠাচ্ছে না।
গত বৃহস্পতিবার এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিভাগের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের লাক্রোয়ার বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের মিশন থেকে বাদ দিতে জাতিসংঘ বিশেষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে থাকে তবে এটি সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ সরকারের শান্তিরক্ষা মিশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনে দায়ী সদস্যদের নিয়োগ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে জাতিসংঘ স্থায়ী সংবাদদাতা মুশফিকুল ফজল আনসারী জানতে চান, গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ত ডেথ স্কোয়াড র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) এর বর্তমান এবং সাবেক সদস্যরা শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়মিত নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছে। আর এটি নিয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ যেনো যাচাই-বাছাই করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতদেরকে মিশন থেকে বাদ দেবার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ বিষয়টি নিয়ে আপনারা কতটুকু উদ্বিগ্ন? যেমনটি তুলে ধরা হয়েছে ডি ডব্লিউ, নেত্র নিউজ এবং ডায়েচে সায়েতিংয়ের করা এক যৌথ অনুসন্ধানী রিপোর্টে। ওএইচসিএইচআর’র মানবাধিকার ব্যবস্থার প্রস্তাবিত মানবাধিকার মানদ- মেনে চলার জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের (ডিপিও) প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি এবং স্ক্রিনিং প্রক্রিয়াগুলি প্রয়োগ করার জন্য জাতিসংঘ কি আজ অবধি বাংলাদেশ সরকারের সাথে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করেছে? উল্লেখ্য, ২৯ মে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকল সদস্যের সম্মানে উদযাপিত এ দিবসে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় শাহাদাতবরণকারী ও আহত সদস্যগণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। ১৯৪৮ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত নানা দেশের ২০ লাখের বেশী শান্তিরক্ষী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের ১১টি মিশনে ৭০,০০০ এর বেশী শান্তিরক্ষী তাদের দায়িত্ব পালন করছে।