ঐক্যবদ্ধ বাংলা বা ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’ প্রতিষ্ঠার পেছনে মুসলমান শাসকদের যে অবদান এবারের নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে তা সচেতনভাবেই পাশ কাটিয়ে অস্বীকার করা হয়েছে। অন্য দিকে মুসলিম শাসকদের সময়কাল তথা মধ্যযুগের সোনালি অধ্যায়কে বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনাকে সামনে নিয়ে এসে গোটা মধ্যযুগকে শুধুু যুদ্ধ বিগ্রহের সময়কাল হিসেবেই দেখানো হয়েছে। এই যুগকে ক্ষমতার লড়াই হিসেবেও দেখানো হয়েছে ।
নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৯ থেকে ৩০ পৃষ্ঠায় একটি অধ্যায়ের আলোচনায় মুসলিমরা যে ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল’ বানিয়েছিল, তাদের হাত ধরেই যে বাঙ্গলাহ প্রথম একীভূত হয়, সেই কথাও অস্বীকার করা হয়েছে। আর এই ধরনের আলোচনা কোনো প্রকার দলিল ছাড়াই একপেশেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় বলা হয়েছে, এক দিকে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং অন্য দিকে ক্ষমতাবান অত্যাচারী শাসকের নানা প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা প্রায় দুই হাজার বছর কাটিয়েছে। তখন ভূখণ্ডটির কোনো একক রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। সেগুলোর কোনো সীমানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। নানা মানুষের বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ড, নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, দ্বন্দ্ব- সঙ্ঘাত আর সমন্বয়ের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলা অঞ্চলের মানুষের সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতি সচেতন হতে থাকে। হাজার বছরের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম বাংলার কাদামাটি আর পানির ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে উঠে এসে সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। সফল হয়েছেন। বাংলা অঞ্চলের পূর্বাংশে নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন। ভাষা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সব নিপীড়িত নিষ্পেষিত মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববন্ধু অভিধায় অভিহিত করা হয়।
অন্য দিকে ইতিহাসের সঠিক যে বর্ণনা আলোচনা থেকে জানা যায়, মধ্যযুগের ইতিহাসের মুসলিমরাই ছিলেন বঙ্গ/বাঙ্গালাহ/ বাংলা ভূখণ্ডের মূল স্থপতি। ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম শাসনকর্তা। তিনি ১৩৪২ সালে সোনারগাঁও বিজয়ের পর সমগ্র বাংলার সুলতান হন, শুধু বাংলার একটি অংশের নন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম স্বাধীন সুলতান ছিলেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন। যারা পরে ১৫২ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তথ্য সূত্র : Bangladesh Politics, Economy and Civil Society, (Cambridge University Press, 2011) p.44
অপর দিকে ক্লাস সেভেনের বইয়ের ৬৭ নং পৃষ্ঠায় এক বর্ণনায় মধ্যযুগে মুসলমানদের অবদানকে তেমন কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। এই আলোচনায় মধ্যযুগকে মুসলিম অবদানের কথাও সেভাবে আলোচনায় আনা হয়নি। পক্ষান্তরে মধ্যযুগকে শুধু যুদ্ধ বিগ্রহের সময়কাল হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া পুরো মধ্যযুগকে কেবলই মাত্র শাসকদের ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মধ্যযুগের শাসকদের মধ্যে সবাই ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং বড় বড় রাজ্য বা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তারা ছিলেন আগ্রহী।
আবার নতুন শিক্ষাক্রমের অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ৭৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, মধ্য যুগে মুসলিম শাসকদের আমলে শুধু মাত্র কিছু মসজিদ আর খানকাহ এর নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের এই আলোচনায় মুসলিম শাসকদের সার্বিক উন্নয়ন কাজকে অস্বীকার করে তাদের অবদানকে খাটো করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় একের পর এক মসজিদ, দরগাহ, খানকাহ নির্মিত হয়েছে। স্থাপনাগুলোর মধ্যে আদিনা মসজিদ গৌড়লখনৌতির ছোট সোনা মসজিদ ও বড় সোনা মসজিদ, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ, বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, মধ্যযুগের এই সময়টাকে পরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছে খোনাখুনি, রক্তারক্তি আর ক্ষমতার দখলের যুগ হিসেবে। অথচ অনুপম চৌধুরী বাংলার সেই স্বর্ণযুগ সম্পর্কে লিখেছেন, চতুর্দশ শতকের শেষে পঞ্চদশ শতকের শুরুতে বাংলা ভাষা তার প্রায় বর্তমান রূপ পেয়েছিল। এ সময়ে এক দিকে শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন অন্য দিকে বৈঞ্চব পদাবলী রচিত হয়েছিল। মুখ্যত রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে অবলম্বন করে এই কৃষ্ণ মহাভারত শ্রীমদ্ভাগদ্গীতা বা ভাগবত এর কৃষ্ণ নন যথার্থ অর্থে। এই কৃষ্ণ একটু স্থূলভাবে বললে বলা যায় একজন প্রেমিক বাঙালি, যার প্রথম অভিনব প্রকাশ আমরা দেখি বাংলা সংস্কৃত গীতগোবিন্দে। বড়– চণ্ডীদাসের আদি বাংলায় লেখা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বাধা কৃষ্ণের প্রেমের মধ্যে দু’জন নর-নারীর দৈহিক প্রেমের কথাই কিছুটা গ্রাম্য স্থূলতার সাথে পরিবেশিত হয়েছে যদিও মাঝে মধ্যে কবিত্বশক্তির কিছু কিছু স্ফূরণ চকিত বিদ্যুতের মতো তাতে মূর্ত। বৈষ্ণব পদাবলীতেই প্রেম এক অসাধারণ রূপ পরিগ্রহ করেছিল। বিশেষভাবে বিদ্যাপতি (ব্রজবুলি) দ্বিজ চণ্ডীদাস গোবিন্দ দাস জ্ঞানদাস প্রমুখের গীতি কবিতায়। অপর এক বর্ণনায় চণ্ডীদাস তার অসাধারণ ভাষায় লিখেছিলেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।
ক্লাস এইটের ৭৯ নং পৃষ্ঠায় অপর এক বর্ণনায় খানজাহান আলীকে শুধু একজন নির্মাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহের শাসনকালে খানজাহান নামক একজন সুফিসাধক সুন্দরবন এলাকায় গভীর বন কেটে জনবসতি গড়ে তুলেন। খানজাহান ছিলেন একজন নির্মাতা। বর্তমানে যেখানে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, অবস্থিত সেই এলাকায় তিনি অনেকগুলো শহর, মাদরাসা, মসজিদ, সেতু নির্মাণ করেছিলেন। নতুন এক স্থাপত্যরীতিতে নির্মাণ করেন ষাট গম্বুজ মসজিদ।
পাঠ্যবইয়ের এই আলোচনায় খানজাহানকে শুধু একজন নির্মাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও মূলত প্রায় সব ইতিহাসবিদের বর্ণনায় এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, খানজাহান শুধু একজন নির্মাতা ছিলেন না, দক্ষিণ-পশ্চিম এই অঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা এবং বাগেরহাট এই এলাকায় ইসলাম প্রচার এবং প্রসারে খানজাহানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সবচেয়ে হাস্যকর এবং ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে একটি ছবি ছাপানো হয়েয়ে নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৫ পৃষ্ঠায়। এখানে ফকির সন্ন্যাসীদের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এমন একটি ছবি ছাপানো হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে হিন্দু সাধুদের। পরনে তাদের গেরুয়া রঙের পোশাক। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ফকির আন্দোলনের নেতারা ছিলেন সবাই মুসলমান। আমাদের শিশুসন্তান কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এই ছবি দেখে বুঝতেই পারবে না এত বড় অবদান আমাদের মুসলিম ফকিরদের ছিল।
প্রকৃত অর্থে সত্যিকার ইতিহাস হচ্ছে এই, ফকির বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০) তে অংশগ্রহণকারী ফকিরেরা ছিলেন মাদারিয়া সুফি তরিকার অনুসারী। সতেরো শতকের শেষার্ধে শাহ সুলতান সুরীয়া বুরহানার নেতৃত্বে এই সুফিরা বাংলায় বেশ প্রসার লাভ করে। ফকির সন্ন্যাসীদের এই বিদ্রোহের মূল আহ্বায়ক ছিলেন মাদারিয়া তরিকার সুফিসাধক মজনু শাহ। অপর একটি সূত্র মতে অর্থাৎ মজনু শাহের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ হায়দার আলী চৌধুরী তারমতে ফকির মজনু শাহের প্রকৃত নাম নূরউদ্দীন বাকের জঙ্গ। তিনি মুঘল বংশীয় একজন শাহজাদা। এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে মজনু শাহের খলিফা ছিলেন সুফি সাধক মুসা শাহ চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ এবং আরো অনেকে। জেমস ওয়াইজ ১৮৬০ এর দশকে ঢাকার সিভিল সার্জন ছিলেন। তিনি ঢাকার মাদারী ফকিরদের সম্পর্কে লিখেছেন, তারা সাদা জামা ও মাথায় কালো পাগড়ি পরত।
তাদের হাতে ঝুনঝুনির মতো বাদ্যযন্ত্র থাকত। গলায় তসবি কিংবা কাঠের পুঁথিমালা ঝুলিয়ে শহরময় ঘুরে ঘুরে পয়সা তুলত। তসবি ও বাদ্ধি বিক্রি করত তারা। পরে এই বিদ্রোহের সাথে ভোজপুরী বাহ্মণ ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানীসহ অন্যান্য বেদান্তীয় হিন্দু যোগীরা যোগ দিতে থাকে। এভাবেই মধ্যযুগেরে সোনালী অধ্যায়ের গৌরবময় মুসলমানদের এক উজ্জ্বল ইতিহাস ছিনতাই হয়ে যায়। আর আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আমাদের অতীতের ইতিহাস পড়া ও জানা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।