পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ মনে হয়েছে। একজন সম্পাদক টকশোতে বলেন, ‘বেনজীরকে দেখলে তিনি ভয়ে সঙ্কুচিত হন। তার নড়াচড়া চলাফেরা ভাবভঙ্গি ও শরীরের আকৃতি মানুষকে ভীত করে দেয়।’ তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যে দাপট তার পূর্ণ প্রতিফলন ছিল বেনজীরের আচরণে। ধারণা করা গিয়েছিল, ডিএমপি কমিশনার, র্যাব-প্রধান ও আইজিপির পর এবার তিনি সরকারের আরো বড় কোনো দায়িত্ব পাবেন। বাস্তবে ঘটল তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। মেরুদণ্ডহীন দুদক এই শক্তিশালী পুরুষকে ধরাশায়ী করে দিলো। বেনজীরের প্রদর্শিত অমিত শক্তি সরকারকে ক্ষমতায়িত করেছে। সেই সরকারই এখন তার শক্তি চূর্ণ করতে দুদকের পেছনে আছে। বেনজীর বিচারের মুখোমুখি না হলেও যতটুকু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেখা গেছে তাতেই অনেকের শিউরে উঠার কথা। যারা বেআইনিভাবে সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা তা করেছেন, তাদের সংখ্যা কম নয়।
একজন হিসাব করে দেখিয়েছেন, পুরো সরকারি চাকরিকালীন যাবতীয় বেতনভাতা যোগ করলে বেনজীরের আয় দুই কোটি টাকার বেশি হয় না। এর সাথে অবসরকালীন ভাতা আরো যদি কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকে- সবমিলিয়ে তিনি চার কোটি টাকার বেশি কোনোভাবেই সরকারি চাকরি থেকে আয় করতে পারেননি। ধরি ৩৩ বছরে সংসারের পেছনে তার ব্যয় হয়ে গেছে দুই কোটি টাকার বেশি। তাহলে পেনশনসহ বাদবাকি কিছু যদি তিনি সঞ্চয় করেন সেটি দুই কোটি টাকার আরো কম হবে। এর সাথে গুলশানে তার কেনা ফ্ল্যাটের দাম তুলনা করে দেখা যাক। চারটি ফ্ল্যাট ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট। কিনেছেন দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা দিয়ে। পেনশন ও বাদবাকি জমানো সমুদয় টাকাও যদি এতে ব্যয় করেন তাতেও এই ফ্ল্যাট তিনি সেই টাকা দিয়ে কিনতে পারেন না।
গুলশান ঢাকা শহরের সবচেয়ে দামি এলাকা। এখানে জমি ও ফ্ল্যাটের দাম তুলনামূলক বেশি। ফ্ল্যাটের জন্য বেনজীরের পরিশোধ করা দাম বিস্ময়করভাবে কম। প্রদর্শিত দাম অনুযায়ী, তিনি এক বর্গফুট কিনেছেন মাত্র দুই হাজার ২৪৩ টাকায়। অথচ এখনকার বাজারদর অনুযায়ী, গুলশানে একটি ফ্ল্যাট কিনতে গেলে কমপক্ষে বর্গফুট ২০ হাজার টাকা পড়ে। নামীদামি কোম্পানি থেকে কিনতে গেলে ফ্ল্যাটের দাম আরো বেশি পড়বে। তিনি এগুলো কি অবিশ্বাস্য কমমূল্যে কিনেছেন, না এখানে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে?
একটি পত্রিকা সাবেক এই আইজিপির সম্পত্তি নিয়ে রিপোর্ট করতে শুরু করে। শুরুতে বেনজীর সাহেব সামাজিক মাধ্যমে এসে ওই সব প্রতিবেদনের বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি অবৈধভাবে কোনো সম্পদ করেননি বলে বিবৃতি দেন। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেল, তিনি অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাট কিনেছেন সেটি তার সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়েও কোনোভাবেই কেনা সম্ভব নয়।
আদালত বেনজীরের সম্পত্তি ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার পর দুদক বেনজীরকে পরিবারসহ ডেকেছে। তার আগে দুই দফায় বিপুল সম্পত্তির যে খতিয়ান পাওয়া গেল, সেটি গুলশানে কেনা সম্পদের চেয়ে কয়েক শত গুণ বেশি হবে। পারিবারিকভাবে তার জমিদারির ইতিহাস নেই। তার সন্তান-স্ত্রীদের মধ্যে কারো বড় ব্যবসায় আছে এমন প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি। এগুলো কেনার যে সময়কাল সেটি তার সরকারি উচ্চ পদের সাথে শতভাগ সম্পর্কিত পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তিনি যত বেশি ক্ষমতাধর- সরকারি পোস্টে পদোন্নতি পাচ্ছেন, সম্পত্তি অর্জনের গতিও ততোধিক পরিমাণে বেড়েছে। ২০০৯ থেকে থেকে ১৯ সালের মধ্যে তিনি ৩৫টি দলিলে ১৫২ দশমিক ৮৫ বিঘা জমি কিনেছেন। সংবাদমাধ্যম আলাদা করে দেখায়নি, ডিএমপি কমিশনার ও র্যাব-প্রধান থাকার সময় কতটা সম্পদ কিনেছেন। তিনি এগুলোর দায়িত্বে থাকার সময় প্রতিষ্ঠানগুলো বিরোধী দলের দমনে ব্যাপক সীমালঙ্ঘন করেছে। ওই সময় সরকারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জোরালো অভিযোগ ওঠে। এমনকি বেনজীর নিজে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞায় পড়েন। তাই ওই সময়ে জমি কেনাসহ সম্পত্তি অর্জনের গতি বেশ বেড়েছিল। তবে ২০২০ সালে আইজিপি নিযুক্ত হলে এ গতি বহু গুণ বেড়ে যায়। মাত্র তিন বছরে তিনি ১৬৩ দলিলে ৪৬৬ দশমিক ৭৯ বিঘা জমি কিনে নেন। পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন আরো বহু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষে শক্তি প্রদর্শনকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো যেন একেকটি আলাদিনের চেরাগ।
এখানে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নিয়েও কিছু বলা দরকার। বিরোধীরা যখন ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে, এই সম্ভাব্য অপরাধীদের নিয়ে দেশের একটি সংবাদমাধ্যমও কোনো ধরনের খবর দেয়নি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে কিছু এ দেশে দেখা যায়নি। দেখা গেছে উল্টো, যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে তাদের তাজিম তোয়াজ। বেশি করে কাভারেজ দেয়া, দাওয়াত করে বিভিন্ন উৎসবে সম্মান প্রদর্শন। ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বেনজীরকে নিয়ে দুদকের পদক্ষেপ ব্যাপক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পীড়নে যখন কোণঠাসা ওই সময় বিরোধীদের পান থেকে চুন খসলে সেখানে দুদক কামান দাগিয়েছে। পুলিশ-প্রধান কিংবা অন্য রাঘববোয়ালদের দিকে তাকাবেন তাদের সেই মুরোদ কল্পনাও করা যায়নি। এখন কোন শক্তির বলে তারা দেশের সবচেয়ে শক্তিধরকে কুপোকাৎ করে দিচ্ছে, সেটি কৌতূহলের বিষয়।
ক্ষমতার অপব্যবহার বাংলাদেশের মানুষের একটি অংশের রুচিতে ব্যাপক বিকৃতি ঘটিয়েছে। দেশের আপামর জনগণ জানত- বেনজীর জাতির প্রতি সঠিক আচরণ করছেন না। তাই তিনি কোনোভাবেই শ্রদ্ধা সম্মান পেতে পারেন না। দেখা গেল, কিছু মানুষ তার সাথে একটি সেলফি তুলতে কাতর। সেটি আবার সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে নিজের কদর বাড়িয়েছে; এমন অনেক মানুষ দেখা গেছে। পুলিশের ভেতরেও বেনজীরের বিশাল ভক্ত দেখা গেছে। যখনই তার কোনো সমালোচনা এসেছে, বেনজীরকে তারা ইতিহাসের সেরা পুলিশ-প্রধান হিসেবে গর্ব করেছে।
এখন স্রোত বিপরীত দিকে গড়াতে শুরু করেছে। সামাজিক মাধ্যমে বেনজীর নিজে ট্রলের শিকার হচ্ছেন। যারা বেনজীরের সাথে সেলফি তুলেছেন তারাও ট্রল খাচ্ছেন। বেনজীরের সাথে থাকা সেলফিগুলো এখন দায়। বেনজীরের ঘনিষ্ঠ হওয়া, বন্ধু হওয়া- এখন খারাপ ও ঘৃণিত কিছু। আমরা জানি না, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সরকার কী চিন্তা করছে। বেনজীরকে ঘাঁটানোর বিষয়টি যদি চুনকামও হয়, অর্থাৎ তার শেষ পর্যন্ত বিচার না-ও হয়, তাতেও যতটুকু হয়েছে এতে বেনজীর ও তার পরিবার সমাজে স্থায়ীভাবে হেয় হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার তার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং ক্ষমতার অপব্যবহার যারাই করছেন, সময় থাকতে হুঁশিয়ার।
jjshim146@yahoo.com