ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে সিলেটের ৪ উপজেলায়। জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে প্রায় ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যা-কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় সারি নদী একদিনে ২০২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়াও, সুরমা নদী কানাইঘাট উপজেলা পয়েন্টে ১৯৬ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৬৬ সেন্টিমিটার ওপর, কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্টে ২২০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ২০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, উপজেলার টিলা এলাকা ছাড়া বাকি সব এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও মানুষের বাড়ির ছাউনি পর্যন্ত পানিতে ডুবে গেছে। এতে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রাতে অন্ধকার ও প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার অভিযানে সমস্যা হচ্ছিল। ভোর থেকে ব্যাপকভাবে উদ্ধার অভিযান চলছে। মানুষজনকে উদ্ধার করা গেলেও গৃহপালিত পশুপাখির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যায় উপজেলার ৭৫ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়েছেন। জাফলং-বিছনাকান্দীসহ সব পর্যটন এলাকার পর্যটকবাহী নৌকা নিয়ে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বন্যার পূর্বাভাস থাকায় আমরা আগেই ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। কাল রাতেই ১৬৭টি পরিবার আশ্রয় নেয়, সকাল থেকে যা ২৫০ ছাড়িয়েছে। অনেক মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পার্শ্ববর্তী উঁচু বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।’ ইউএনও আরও জানান, বন্যা-কবলিত মানুষের জন্য আগের বরাদ্দ ৪৮ টন চালের সঙ্গে নতুন ১৫ টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও, ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বন্যা কবলিতদের ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসাইন বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতি গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি খারাপ। স্থানীয়দের সহযোগিতায় উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। প্রয়োজনে তারাও উদ্ধার অভিযানে যোগ দেবে।’ তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক হয়েছে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল-রুম খোলা হয়েছে। বন্যা-কবলিত মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে।’
জকিগঞ্জে ডাইক ভেঙে ৫০ গ্রাম প্লাবিত
এদিকে ভারতের বরাক নদী দিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের জকিগঞ্জে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে ডাইক ভেঙে অন্ততপক্ষে ৪০/৫০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল নিজগ্রামে, কাজলসার ইউপির আটগ্রামের নালুহাটি গ্রামে সুরমা নদীর ডাইক ও জকিগঞ্জ সদর ইউপির ছবড়িয়া, বাখরশাল, রারাই, খলাছড়া ইউপির ভূইয়ারমোড়া, বিরশ্রী ইউপির মাঝরগ্রামসহ কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন এলাকার ডাইক ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকতে শুরু করে। এ ছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ডাইক উপচে নদীর পানি গ্রামে ঢুকার খবর পাওয়া গেছে।
গভীর রাতে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটে চলেছেন। বসতঘরে পানি ঢুকে গেছে। গৃহপালিত পশু পাখি নিয়ে পড়েছেন বেকায়দায়। আবার কেউ কেউ পানিবন্দী অবস্থায় বাড়িতেই অবস্থান করছেন। বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর মানুষ।
সব পর্যটন স্পট বন্ধ ঘোষণা
নিজস্ব প্রতিবেদক, সিলেট : নদ-নদীতে পানি বেড়ে যাওয়া ও বন্যার কারণে সিলেট জেলার সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। বুধ ও বৃহস্পতিবার সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ ঘোষণা দেয়।
সিলেটের উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো হচ্ছে- কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর ও বিছানাকান্দি, গোয়াইনঘাটের জাফলং ও রাতারগুল এবং জৈন্তাপুরের লালাখাল।
কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন কমিটির আহবায়ক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ জানান, উপজেলার ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং পর্যটন কেন্দ্রসমূহ পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সাদাপাথর পর্যটন ঘাটসহ সকল পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।
জাফলং পর্যটন স্পট বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন- গতকাল (বুধবার) এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।