প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত উপক‚লজুড়ে এখনো চলছে মানুষের আহাজারি। রিমানের তান্ডবে প্রাণ গেছে ২৩ জনের। প্রায় ২ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। মাছের ঘের, পুকুর তলিয়ে সব মাছ ভেসে যাওয়ায় অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আউশের বীজতলা, পাট ক্ষেত, ধান ক্ষেত, তিল, আম, লিচু, মরিচসহ নানা সবজির ক্ষেত তলিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে অনেক কৃষক। বরিশাল ও খুলনায় বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। বেড়িবাঁধের ৪০০ জায়গা ভেঙে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এসব বাঁধ মেরামতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। রিমালের আঘাতের ৪ দিন পরও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে উপকূলের অনেক এলাকা। রিমালের অঘাতে বিশ্ব ঐহিত্যের অংশ সুন্দরবন তছনছ হয়ে গেছে। সুন্দরবনের প্রায় ৩৯টি হরিণসহ অন্যান্য প্রাণী নিহত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী এই ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ। তাদের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস এখনো ভারী হচ্ছে। সুন্দরবনসহ খুলনা জেলার অনেক এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে খাবার পানির সঙ্কট। অথচ দুর্গতদের কষ্ট-দুর্দশা দেখার কেউ নেই। চার দিন পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে কেউ নেই। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা খুবই অপ্রতুল।
ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপক‚ল ও এর আশপাশের ১৯টি জেলায় প্রায় পৌনে ২ লাখ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে এর প্রভাবে কৃষি খাতে সারাদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী দেশের ৪৮ জেলায় কৃষিতে রিমালের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১৩টি জেলা। রিমালের আঘাতে ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ১০৯ হেক্টর ফসলি জমির। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে বরিশাল অঞ্চলের ছয়টি জেলা। এগুলো হলোÑ বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা। এ ছাড়া খুলনা অঞ্চলের চার জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন জেলা নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার জেলার কৃষিতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দুর্যোগের কবলে পড়েছে ৫২ হাজার ১৯০ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি, ১০ হাজার ৮৪৩ হেক্টর আউশ বীজতলা, ২১ হাজার ৪৩৪ হেক্টর আউশের জমি, ৭ হাজার ৭৩০ হেক্টর জমির বোরো ধান, ৪ হাজার ৮২৬ হেক্টর জমির বোনা আমন, ২৯ হাজার হেক্টরের বেশি জমির পাট। এ ছাড়া তিল ও মরিচেরও বেশ ক্ষতি হয়েছে। আর ৭ হাজার হেক্টরের বেশি জমির পান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মাছের ঘেরগুলোতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে মৌসুমের শুরুতে সাদা সোনা হিসেবে পরিচিত বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘেরগুলো জলোচ্ছ¡াসে প্লাবিত হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কয়েক লাখ মৎস্য চাষি। খুলনা বিভাগীয় বিভাগীয় মৎস্য অফিস ক্ষয়ক্ষতির একটি তালিকা তৈরি করেছে। তাতে দেখা গেছে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় মোট ৬০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষয়ক্ষতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে তুলে ধরা হলো :
চট্টগ্রাম থেকে শফিউল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তান্ডবের ভয়াল চিহ্ন একের পর এক ভেসে উঠছে। ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গত জনসাধারণ সরকারের জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তার আশায় তাকিয়ে আছেন, কিন্তু ত্রাণ পাচ্ছেন না। উপকূলের অনেক জায়গায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছাসের ছোবলে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ। ভাঙা বাঁধ দিয়ে সামুদ্রিক জোয়ারের লোনা পানি হু হু করে এসে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। এখনও অনেক গ্রাম-জনপদ ডুবে আছে। এর প্রভাবে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এতে সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকা।
ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’র সক্রিয় প্রভাবে রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় চট্টগ্রামে ২৩৫ মিলিমিটার। অতি ভারী বর্ষণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যাপক এলাকা হাঁটু থেকে বুকসমান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে করে বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাভাবিক লেনদেন, জীবনযাত্রা থমকে যায়। হাজারো বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কাদা-পানি, বালি, ময়লা-আবর্জনায় সয়লাব হয়ে যায়। গুদামজাত ভোগ্যপণ্য, সার, নিত্যপণ্য চাল-ডাল-গম ইত্যাদি ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামে মারা গেছেন দুইজন। অথচ চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমালে’ ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ খাদ্যসামগ্রী, গৃহ নির্মাণ সামগ্রীসহ সরকারের জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসন সাহায্য এখন পর্যন্ত পাননি। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্তারা কার্যত নির্বিকার।
বরিশাল থেকে নাছিম উল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপদ্রুত বরিশালের প্রায় ৩৮ হাজার পরিবারের দুই লাখ মানুষের জন্য এখনো ত্রাণ তৎপরতা খুবই সীমিত। রিমাল গত ২৬ মে সন্ধ্যার পর আঘাত হানার পর থেকে ১৮ ঘণ্টা ধরে বরিশাল উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়ার পর বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ এখনো পরিপূর্ণভাবে পুনর্বাসন সম্ভব হয়নি। অপরদিকে ত্রাণের বিষয়টিও খুবাই সীমিত থাকার মধ্যেই সরকারিভাবে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদসহ একাধিক খাতে পুনর্বাসনের তেমন কোনো তৎপরতাও দৃশ্যমান নয়।
তবে বরিশালের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য এ পর্যন্ত ৩শ’ মেট্রিক টন চাল ও ২৫ লাখ নগদ অর্থ সতায়তা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে বলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাতেই সরকারি কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান সংগ্রহে যাননি। এমনকি খোদ বরিশাল সিটি করপোরেশনের অনেক বর্ধিত এলাকায়ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরগণ গতকাল পর্যন্ত পৌঁছেননি বলে অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
নগরীর কালিজিরা নদীর অপর পাড়ে ২৬ নম্বর ওয়ার্ডেরে চর জাগুয়া এলাকায় একটি চৌচালা ঘরের ওপর ৬টি গাছ পড়ে বিধ্বস্ত হলেও অলৌকিকভাবে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও পুরো পরিবারটি প্রায় সর্বসান্ত হয়ে গেছে। রিমাল আঘাত হানার ৩ দিন পরও সেখানে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পৌঁছলেও কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি। খোদ সিটি করপোরোশন এলাকার অনেক বর্ধিত অংশেই এ ধরনের ঘটনা বাস্তব হলেও জেলার উপজেলাসহ নদ-নদী বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলো অবস্থা আরো করুণ বলে জানা গেছে। তবে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানিয়েছেন তারা মন্ত্রণালয় থেকে যেসব বরাদ্দ পেয়েছেন তা ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে বরাদ্দ দিয়ে দ্রুত বিতরণের তাগিদও দিয়েছেন। পাশাপাশি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরো ত্রাণসহ পুনর্বাসনের অর্থপ্রাপ্তির ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
খুলনা থেকে আসাফুর রহমান কাজল জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবের ক্ষত এখন স্পষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবন, বেড়িবাঁধ, মৎস্য ঘের, পশুপাখি, ফসল, আবাসন, প্রাণহানিসহ বিভিন্ন খাতে ক্ষতের চিহ্ন রেখে গেছে রিমাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী কয়েক বছর লেগে যাবে উপকূলীয় অঞ্চলের এ ক্ষতের দাগ মুছতে। যদিও ২০০৯ সালে উপক‚লে ঘটে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার দাগ এখনো মোছেনি।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, খুলনাঞ্চলের অর্থাৎ খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে প্রায় ৮২ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। প্লাবিত হয়েছে বহু গ্রাম। এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে খুলনা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালে খুলনার উপক‚লীয় অঞ্চলের ১৭ হাজার ৭৯৬ দশমিক ৫০ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে ৪০ হাজার ৫১৫টি চিংড়ি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে চিংড়িতে ৩২৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া তিন জেলায় ৮১ হাজার ১শ’টি পুকুর বিনষ্ট হওয়ায় আরও ২৪৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ঘের ভেঙে যাওয়া, অবকাঠামোর ক্ষতিসহ মৎস্য খাতে মোট ৭২১ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম জানান, এরই মধ্যে মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে তাদের প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো জানান, টানা ৩৬ ঘণ্টা ধরে ডুবে ছিল সুন্দরবন। এত দীর্ঘ সময় সুন্দরবন জলমগ্ন থাকায় বনের বিশেষ করে বণ্যপ্রাণীর অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবারের ঝড়ে বাঘ, হরিণসহ অন্য বন্যপ্রাণীর শাবক বেশি মারা গেছে। ৩৯টি মৃত হরিণ উদ্ধারের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে।
পানি উন্নযন বোর্ডের খুলনা বিভাগীয় প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা জানান, খুলনাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৮২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জরুরি মেরামত করা প্রযোজন। রিমালে ৮টি স্থান ভেঙে গেলেও ৬টি স্থান আটকানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কয়রার দশহালিয়া ও পাইকগাছার গড়ইখালী বাঁধ এখনও আটকানো যায়নি। ৮২ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতে প্রয়োজন ৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু এখনো কোনো বরাদ্ধ পাওয়া যায়নি। মন্ত্রীর নির্দেশে বাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গতকাল ভাঙন এলাকা পরিদর্শনের পর ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে সংস্কারের কাজ করা হবে।
কক্সবাজার ব্যুরো ও জেলা সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে কক্সবাজার উপক‚লে খতিগ্রস্ত লবণ মাঠ, মৎস্য খামার ও বেড়িবাঁধ। এতে তলিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক গ্রাম। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩শ’র মতো মৎস্য ঘের ও কয়েকশ’ লবণ মাঠ। দেখা গেছে, মহা বিপদ সংকেত নামানোর পরই বৃষ্টিপাত এবং সাগরের পানি বেড়েছে। এছাড়া পানিতে তলিয়েছে ২৮২টি মৎস্য ঘের। ৮০০ হেক্টর জমির শাকসবজি ও ৬০ হেক্টর পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫৩ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার জেলার ৪ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নে ২৮২টি মৎস্য ঘের ও ৩১০টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৮ লাখ টাকার। এ তথ্য জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র পেতে আরও একটু সময় লাগবে।
সাতক্ষীরা থেকে আক্তারুজ্জামান বাচ্চু জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের ক্ষত নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন শ্যামনগর উপক‚লীয়বাসী। গত ২৬ মে রাতে শুরু করে দীর্ঘ আট ঘণ্টা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে এ ঝড়। ঝড়ের আঘাতে আঘাতে প্রায় ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আশ্রয়হীন এসব মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর। শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিবুল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ভুরুলিয়া, কাশিমাড়ি, ভেটখালি, শ্যামনগর সদরসহ ১২টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫৪১টি কাঁচা ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ৯৩টি বাড়ি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে থেকে সহায়তা করে যাচ্ছে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন। পদ্মপুকুর ইউপির সংরক্ষিত সদস্য জাহানারা খানম বলেন, ত্রাণ নয়, টেকসই মজবুত বাঁধ চাই। সরকার সেই ব্যবস্থাই করুক।
বাগেরহাট থেকে এস এম সামছুর রহমান জানান, উপক‚লীয় জেলা বাগেরহাটের মানুষ প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা ও আম্পানের পর আরো একবার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তাÐব দেখল। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় এসে লÐভÐ করে দেয় উপক‚লবাসীর ঘরবাড়ি, জলোচ্ছ¡াসে ভাসিয়ে নেয় মাছের ঘের ও ফসলের ক্ষেত। রক্ষা পায় না বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপক‚ল অতিক্রম করার পর যতই সময় গড়াচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন। ঘূর্ণিঝড়টি উপক‚ল অতিক্রমের ৫ দিন পেরিয়ে গেলেও বহু মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে এখনো। গাছ পড়ে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে এ জেলায়। জেলার মোট ১২ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে। বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা: খালিদ হোসেন বলেন, এই ঝড়ে ৫ লক্ষ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ৭৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১৯ লক্ষ টাকা, ১১ হাজার কেজি চিঁড়া, ৭শ’ কেজি গুড় ও ২০ হাজার প্যাকেট বিস্কুট দিয়েছি। এদিকে ঘূর্ণিঝড়টি উপক‚ল অতিক্রম করার ৪ দিন পরও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বাগেরহাট উপক‚লের ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহক।
নোয়াখালী থেকে এহসানুল আলম খসরু জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া, সুবর্ণচর ও সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাতিয়া উপজেলায় প্রায় ৭০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উপজেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে হাতিয়ার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে প্রায় ৩৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট, ২ হাজার গবাদিপশু ভেসে গেছে, চার হাজার কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ওই চিঠিতে জোয়ারে প্লাবিত এলাকাগুলোয় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এখনো কোনো ত্রাণ তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। শুধু জেলার উত্তর হাতিয়ায় নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা: মাছুম ইফতেখারের নেতৃত্বে মেডিক্যাল টিম পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, স্যালাইন ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়।
বরগুনা থেকে জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে লণ্ডভণ্ড হয়েছে উপক‚লীয় জেলা বরগুনা। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাছের ঘের, পানের বরজ ও বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে গিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে গোটা উপক‚লীয় অঞ্চল। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর থেকেই গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরের কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও জেলার ছয়টি উপজেলার কয়েক লক্ষাধিক মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। সবকিছু সচল করতে মাঠে কাজ করছে প্রশাসন। ইতোমধ্যেই প্রশাসন ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, চাল, ডাল, লবণ, আটা ইত্যাদি ত্রাণ হিসেবে সরবরাহ করছে। ওই সকল ত্রাণসামগ্রী চাহিদা অনুপাতে নিতান্তই অপ্রতুল বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। রিমালে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হাজারো পরিবারের সদস্যগণ খোলা আকাশের নিচে ছাপড়া দিয়ে কোনোমতে বসবাস করছেন। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে বরগুনায় ১৬ হাজার ৪০৮টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত তিন হাজার ৩৭৪টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ১৩ হাজার ৩৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার ৭০০ মানুষ। বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সচেতন মহলের ধারণা, সরকারি হিসাবের চেয়ে এর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থেকে আছাদুজ্জামান খন্দকার জানান, ঘুর্ণিঝড় রিমালের পর চার দিন পেরিয়ে গেলেও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ সচল হয়নি। পাকুন্দিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় প্রায় ৭৪ হাজার গ্রাহক এখনো বিদ্যুৎ পাননি। এতে জনজীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। ফলে রান্নাবান্না, পড়াশোনাসহ টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট পরিসেবাও ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ অফিস বলছে, প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে অনেক জায়গায় বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ায় এবং গাছপালা পড়ে তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে এমনটা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থেকে জ. ই. আকাশ জানান, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের কৃষকেরা। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা দমকা হাওয়ায় এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠের পাকা বোরো ধান নুয়ে পড়েছে। শুধু ধানই নয়, বাতাসে পড়ে গেছে ভুট্টা, মরিচ, তিল ও পাটসহ বিভিন্ন জাতের ফসল। তবে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে পাকা ধান আর মরিচে। মরিচ গাছ নুয়ে পড়ার পাশাপাশি ফুল ঝড়ে পড়ে গেছে।