প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সারা দেশে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হলেও বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা-উপজেলাগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার-হাজার পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। ভেঙে পড়েছে কয়েক হাজার গাছ। ফল-ফসল, তরিতরকারি এবং পানের বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে সহস্রাধিক গবাদিপশু। সারা দেশে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় হাজার হাজার কাঁচা-পাকা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়া, পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া ও ইন্দুরকানি, নরসিংদী, ঝালকাঠি, বাগেরহাটের শরণখোলা এবং বরগুনা সদরে গাছ ও ঘরচাপা পড়ে এবং পানিতে ডুবে শিশু ও বৃদ্ধসহ আরও ১১ জন মারা গেছেন। এর আগে সোমবার ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপকূলের ছয় জেলার ১৫টি উপজেলায় ৬৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এছাড়া মাছ চাষের অবকাঠামো পুকুর, ঘের ও স্লুইসগেট ধ্বংস হয়েছে তিন হাজার ৬৩৫টি। নৌযান, ট্রলার ও জলযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪১টি। সবকিছু মিলিয়ে যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৬৯৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এছাড়া ৫টি ছাগল, ৩টি ভেড়া, চার হাজার ৫৫০টি মুরগি এবং ৪৭টি হাঁস মারা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে মাছ ছাড়া অন্যান্য খাতে মোট প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি ৪১ লাখ ১২ হাজার টাকা। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৬৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা, খুলনা বিভাগে ৭১ লাখ ৮২ হাজার ৮শ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক চিত্র এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান কর্মকর্তারা। তারা আরও জানান, প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সরেজমিন অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে তা জানানো যাবে। অপরদিকে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আল্লাহর রহমতে ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। যেসব জেলায় পাকা ধান মাঠে সেসব জেলায় বাতাস বৃষ্টিবাদল হয়নি। বাতাসের গতিও ছিল স্বাভাবিক। তবে রিমালে আক্রান্ত জেলাগুলোতে কিছু আমন ধানের বীজতলা নষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া আম ও লিচুর তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি রিমাল। যেসব জেলায় রিমাল তাণ্ডব চালিয়েছে সেখানে আম ও লিচু ছিল না বলে জানান তাজুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আমপ্রধান জেলার উপপরিচালকদের নিয়ে মিটিং করেছি। তারা জানিয়েছেন আম ও লিচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। রিমাল আক্রান্ত জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রতিবেদন দিতে বলেছি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আব্দুল ওয়াদুদ যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনস্থ উপজেলা পর্যায়ের সব অফিসারকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিরা যাতে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, এই মুহূর্তে আমাদের হাতে থাকা তথ্য হচ্ছে-ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে আংশিক এবং সম্পূর্ণ মিলে এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি। ঘূর্ণিঝড়ে মোট ১৯টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর এবং যশোর। ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংখ্যা ১০৭টি এবং ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৯১৪টি। ঘূর্ণিঝড়ে ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৩০ মে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর
নরসিংদী : নরসিংদীর চরাঞ্চল সগরিয়া পাড়ায় ইটের স্তূপের চাপায় স্বামী-স্ত্রী নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার ভোরে সদর উপজেলার চরাঞ্চল করিমপুর ইউনিয়নের সগরিয়াপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন সগরিয়াপাড়া গ্রামের ইট ব্যবসায়ী কালো খাঁ (৭০) ও তার স্ত্রী সবমেহের (৬০)। জানা যায়, সম্প্রতি ইট ব্যবসায়ী আব্বাস মিয়া কালো মিয়ার টিনশেড বাড়ি ঘেঁষে উঁচু স্তূপ করে ইট রেখেছিলেন। সোমবার ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নরসিংদীতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হলে ইটের নিচের মাটি সরে যায়। ফলে ইটের স্তূপ ভেঙে পড়ে ঘরের ভেতর নামাজপড়া অবস্থায় কালো মিয়া ও তার ঘুমন্ত স্ত্রী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। সকালে আশপাশের মানুষ এসে তাদের উদ্ধার করেন।
ভোলা : ভোলায় ঝড়ের তাণ্ডব চলে সোমবার বিকাল পর্যন্ত। টানা ২ দিনের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে কমপক্ষে ৫ শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। ভেঙে পড়েছে অসংখ্য গাছপালা। মঙ্গলবার সকাল থেকে মোবাইল নেটওয়ার্কে ছিল না স্বাভাবিক গতি। মেঘনা পাড়ের বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান এলাকায়। বাঁধ ধসে পানি প্রবেশ করেছে মনপুরায়। ভোরে জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে ২০টি দ্বীপ চর। বিধ্বস্ত হয়েছে ইলিশা ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাট। নদীর পাড়ে রাখা অর্ধশতাধিক জেলে নৌকা ডুবে গেছে।
বরিশাল : বরিশাল জেলায় প্রায় ৩ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ২ হাজার ৬৮৫টি ঘরবাড়ি। মঙ্গলবার বরিশাল জেলা প্রশাসন সূত্রে এসব তথ্য জানানো হয়। এর বাইরেও হাজার হাজার গাছ উপড়ে পড়েছে। বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
দুমকি (পটুয়াখালী) : দুমকিতে কয়েক শতাধিক কাঁচা ও পাকা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালা ভেঙেছে, কাঁচা ও পাকা সড়ক, বৈদ্যুতিক খুঁটি, মাছের ঘেরসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে উপজেলার মুরাদিয়া, পাঙ্গাসিয়া, লেবুখালী, শ্রীরামপুর, ভাঙ্গারিয়া ইউনিয়নের অনেক জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার। পল্লী বিদ্যুতের ইঞ্জিনিয়ার মো. ইমরান হোসেন বলেন, উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের শতাধিক খুঁটি ভেঙে ও তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎহীন রয়েছে পুরো উপজেলা। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম তালুকদার বলেন, ৫০টি মাছের ঘের ও ৫০০টির মতো পুকুর পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, মুগ ডাল, কলা ও পেঁপের বাগানসহ কৃষি জমির অনেক ক্ষতি হয়েছে।
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর) : কয়েকশ কাঁচা বাড়ি, দোকানপাট, গোয়ালঘর, রান্নাঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কৃষির ব্যাপক ক্ষতি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে পৌর শহরের প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের সামনের সড়কের পাশে এক ভবঘুরে (৬৫) ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। সংবাদ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সমাজ সেবা কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সবার ধারণা বৃষ্টিতে ভেজায় ও ঠান্ডার কারণে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ভবঘুরে ব্যক্তির কোনো ওয়ারিশ কিংবা স্বজন না থাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ূম স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর মো. সগীর হোসেনকে দাফনের দায়িত্ব দেন বলে এ কাউন্সিলর নিশ্চিত করেছেন।
ঝালকাঠি : ঝালকাঠিতে ৬ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম জানান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬ হাজার ১৯০ হেক্টর কৃষিজমির ফসল। বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে সাড়ে ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ হাজার ৭০টি পুকুর ও ১৫৯টি মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলায় গাছ চাপা পড়ে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর গাছ পড়ে রোববার রাত থেকে গোটা জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি নামতে শুরু করেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকার সড়কে এখনো উপড়ে পড়া গাছ পড়ে আছে।
সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর ও আশাশুনিতে জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ উপচে এবং প্রবল বর্ষণে মৎস্যঘের প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে জেলে পল্লী। বিধ্বস্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৬৮ বাড়িঘর। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার ১৭৬ মানুষ। এছাড়া ফসলের মাঠ, ঘের-পুকুর লোনা পানিতে ভেসে গেছে। এ তথ্য জানিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির।
নোয়াখালী : অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে দুই হাজারের বেশি গবাদিপশু ভেসে গেছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীস চাকমা। তিনি বলেন, এ ছাড়াও আট হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে এবং ৩৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাতিয়া (নোয়াখালী) : নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়াতে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফেরার পথে পানিতে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুটির নাম মো. মান্না (১২)। সে উপজেলার নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রামের মোক্তার বাড়ির নবীর উদ্দিনের ছেলে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
বান্দরবান : ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে বেইলি ব্রিজ দেবে গিয়ে বান্দরবান থেকে রুমা-থানচিতে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। একই সঙ্গে ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) : রায়পুরে সোমবার রাতে রিমালের আঘাতে এবং জলাবদ্ধতায় কয়েকশ চাষির পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপজেলার প্রায় ১৩শ পানচাষির ৩৫০ হেক্টর জমির বরজ প্লাবিত হয়েছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তর।
খাগড়াছড়ি : টানা বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের ২০ গ্রামের এক হাজারের বেশি পরিবার জলাবদ্ধ হয়েছে। জেলা সদরের অন্তত ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি বেড়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেড কোয়ার্টার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজার।
ভাণ্ডারিয়া (পিরোজপুর) : পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ৩ জন নিহত হয়েছেন। অসংখ্য ঘর-বাড়িসহ শত শত গাছপালা ভেঙে পড়ে উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহসহ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, তেলিখালী গ্রামে ঘরের ওপর গাছ ভেঙে পড়ে মাজেদা বেগম (৭৫) নামের এক গৃহবধূ এবং গৌরিপুর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী বলতলা গ্রামে যাওয়ার পথে গাছের নিচে চাপা পড়ে মো. জাকির হোসেন (৪৫) ও পৌরশহরের দিহান (৪ বছর) নামের এক শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে ১০-১৫ দিন সময় লাগবে। উপজেলা সদরে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করতে জোর তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
মনপুরা (ভোলা) : ঘূর্ণিঝড় থেমে যাওয়ার পর বিপর্যস্ত ভোলার মনপুরায় ভেসে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, সবজি খেত ও পাকা-কাঁচা রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়। শত শত পুকুর ও ঘেরের মাছ জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে। গত তিন দিন ধরে হাজার হাজার মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জানান, উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে দুই হাজার পাঁচশ ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়। এর মধ্যে ৫শ সম্পূর্ণ ও ২ হাজার ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে। তবে জনপ্রতিনিধিরা জানান ৫ হাজারের ওপরে ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়।
নিয়ামতপুর (নওগাঁ) : ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে স্কুল যাওয়ার পথে সড়কের ধারের বড় গাছের নিচে চাপা পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন বেনীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সালাহ্ উদ্দীন। সোমবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে উপজেলার চনদননগর ইউনিয়নের বামইন-বেনীপুর সড়কের তৌফিকের মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। পরে স্থানীয়রা ছুটে এসে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নিয়ামতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সালাহ্ উদ্দীন উপজেলা সদরের মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা।
কাউখালী (পিরোজপুর) : ৫-৬ ফুট জলোচ্ছ্বাসে মঠবাড়িয়া, কাউখালী, ইন্দুরকানী, ভাণ্ডারিয়াসহ অধিকাংশ নিম্নাঞ্চলের মানুষ এখনো পানিবন্দি। এদিকে পিরোজপুর শহরের পাড়েরহাট সড়কের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শাহীনুর রহমান শামীম সোমবার রাতে ঝড়ের সময় নিজ বাসার আইপিএসের বৈদ্যুতিক লাইন খুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন।
শরণখোলা (বাগেরহাট) : উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের বিধানসাগর গ্রামে ফজলা বেগম (৫০) নামে এক নারী বসতঘরে গাছচাপায় মারা গেছেন।
ইন্দুরকানী (পিরোজপুর) : পিরোজপুরের ইন্দুরকানীতে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ঘরের ওপর গাছচাপায় চানবরু বিবি (৬৫) নামে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার ভোররাতে উপজেলার বালিপাড়ার উত্তর ঢেপসাবুনিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
কাঁঠালিয়া (ঝালকাঠি) : রোববার বিকালে গাছচাপা পড়ে উপজেলার বলতলা গ্রামে জাকির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন।
সিলেট : ঘূর্ণিঝড় রিমাল লন্ডভন্ড করে দিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিমানের শিডিউল। মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঝড়। ঝড়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় সাড়ে তিন লাখ গ্রাহক সোমবার রাত থেকে বিদ্যুৎহীন রয়েছেন। তবে মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার কাজ শুরু হয়েছে। এদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও ব্যাহত হচ্ছে।
এছাড়া কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সোমবার দিন ও রাতে ঝড় ও বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতা ও গাছের ডালপালা ভেঙে বসতঘরের ওপর পড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দাউদকান্দি পৌর এলাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজশাহীর বাঘায় আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে সবজি, পেঁপে এবং কলার কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ফেনীর সোনাগাজীতে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ফসলের প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে টানা বৃষ্টিতে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ধলাই নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১১ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ১০ স্থান ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায় আড়াই হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ময়মনসিংহের ফুলপুরে চারশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ও অসংখ্য গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে। মারুয়াকান্দি গ্রামে ঘরচাপায় হোসেন আলী (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ আহত হয়েছেন। খুঁটি উপরে ও তার ছিঁড়ে সোমবার সকাল ৮টা থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন বিকাল ৪টার দিকে পৌরসদরে বিদ্যুৎ এলেও গ্রামাঞ্চলে যায়নি। দীর্ঘ সময় মোবাইল নেটওয়ার্কও বন্ধ থাকে। গাইবান্ধায় উঠতি ফসলসহ কলা, পটোল, করলা ও বিভিন্ন শাক-সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিছু স্থানে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। বরগুনার তালতলীর ৭টি ইউনিয়নের ঘরবাড়ি, দোকানপাট তছনছ হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। টানা ২ দিনের বৃষ্টিতে মৌলভীবাজারের নদী ও হাওরে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ১৭ সেমি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং মনুনদীর পানি বিপৎসীমার ছুঁই ছুঁই অবস্থা। পাহাড়ি ঢলে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নিম্নাঞ্চলের আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সড়ক যোগাযোগ। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। পটুয়াখালীর বাউফলে ঘূর্ণিঝড় রিমেলের তাণ্ডবে মৎস্য, কৃষি, সড়ক, বিদ্যুৎ, বনজ ও গ্রামীণ অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২শ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনয়ন ও চরদুয়ানি, কাকচিড়া ও করমেঘা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ ভেঙে হাজার হজার বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে পাঁচ শতাধিক গবাদিপশু মারা গেছে। লক্ষ্মীপুরে রামগতি-কমলনগরে মেঘনার তীর রক্ষা বাঁধে ধসের খবর পাওয়া গেছে। ঝালকাঠির নলছিটিতে শত শত গাছপালা উপড়ে পড়েছে এবং মাছের ঘের ভেসে গেছে। ভোলার চরফ্যাশনে ৬ হাজার বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।