ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের পানিতে প্লাবিত হয়েছে গোটা সুন্দরবন। এতে প্রায় ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ৩৯টি মৃত হরিণ। আহত ১৭টি হরিণ উদ্ধার করার পর শুশ্রূষা করে সুন্দরবনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জলোচ্ছ্বাসের কারণে সুন্দরবনের মিষ্টি পানির আধার শতাধিক পুকুর লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বনের অবকাঠামো, জেটি, পন্টুন, আবাসনও ভেঙে পড়ে এবং স্রোতের টানে ভেসে যায়। তছনছ হয়েছে বৃক্ষরাজি।
রিমাল আঘাত করার সময় ৭০-৮০ কিলোমিটার গতির ঝড়ো বাতাস ও দমকা হাওয়ায় বনের বহু গাছপালা ভেঙে গেছে। বনবিভাগের বিভিন্ন স্টেশনের কাঠের জেটি, বনরক্ষীদের ঘর, স্টেশন ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতাধিক পুকুর লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হওয়ায় খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বনরক্ষীরা গত দুদিন বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেছেন। যা দিয়ে সপ্তাহখানেক চলবে তাদের। এরপর পানি সংকট দেখা দেবে। শুধু বনরক্ষী নয়, সুন্দরবনের সব প্রাণীর একটি বড় অংশ এ পানির ওপর নির্ভরশীল। তাদেরও জীবন ধারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঝড়ের পর প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের কারণে গাছপালার চেয়ে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারণ দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টাব্যাপী সুন্দরবন ১০ থেকে ১২ ফুট জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এ সময় সুন্দরবনের নদ-নদীতে ঘূর্ণি বাতাসের সঙ্গে প্রচণ্ড ঢেউ ছিল।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নামের মোহসীন হোসেন বলেন, টাকার অঙ্গে বনের ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। আমাদের অংশে (পশ্চিম বিভাগে) ২ কোটি ৬২ লাখ টাকার অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জেটি, ট্রলার, ওয়াচ টাওয়ার, স্টেশন ও স্টেশনের বিভিন্ন ঘর। তিনি বলেন, বনের গাছাপালার যে ক্ষতি হয়েছে সেগুলো দৃশ্যমান। তবে প্রাণীদের জন্য বিপর্যয় ছিল এই ঝড়। গাছে গাছে অসংখ্য পাখির বাসা ছিল। যাতে ডিম ছিল সেগুলো নষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে সব প্রাণীই তাদের আবাসস্থল হারিয়েছে। এগুলো আর্থিক মানদণ্ডে বিচার করা সম্ভব নয়। যেহেতু সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে ইকো ব্যালেন্স রয়েছে। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।
সূত্র জানিয়েছে, হরিণের পাশাপাশি একটি বন্য শূকর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
সুন্দরবনের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, দুবলা, বুড়ি গোয়ালিনী, কোকিল মনি, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া ফরেস্ট ক্যাম্পসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী ও সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীসহ অন্য গাছের কী ক্ষতি হয়েছে, এটি এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম বলেন, নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা ওয়্যারলেস এখনো সচল হয়নি। তবে বনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্টেশনে দায়িত্বরত ও কর্মকর্তা বনরক্ষীরা নিরাপদে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কাজ চলছে।
সুন্দরবন নিয়ে গবেষণাকারী সেফ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বাঘ বা হরিণ জাতীয় বন্যপ্রাণী ৬ ঘণ্টার বেশি পানির মধ্যে প্রতিকূল পরিবেশের টিকে থাকতে পারে না। ঝড়ের প্রভাবে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা দীর্ঘ সময় জলমগ্ন ছিল। ভাটার সময়ও এবার পানি কমেনি। এতে অসংখ্য বন্যপ্রাণী ভেসে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় নুতন করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন।