রাজধানীতে মৌসুম শুরুর আগেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রভাব। রাজধানী ঢাকার দুই সিটির ১৮টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে বেশি। বহুতল ভবন ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে গত ১৭ই থেকে ২৭শে এপ্রিল পর্যন্ত চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে-২০২৪ এর ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ নামে পরিচিত। স্বীকৃত এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলে মনে করা হয়। দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো- ১২, ১৩, ২০, ৩৬, ৩১, ৩২, ১৭, ৩৩ নং ওয়ার্ড।
আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো- ৪, ১৩, ৫২, ৫৪, ১৬, ৩, ৫, ১৫, ১৭, ২৩ নং ওয়ার্ড। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ১২ নং ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে এডিসের ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৪৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ১৩ নং ও ২০ নং ওয়ার্ড। এগুলোতে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ৪০ শতাংশ। ৩৬ নং ওয়ার্ডে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৩১ নং ও ৩২ নং ওয়ার্ডে ৩০ শতাংশ, ১৭ নং ও ৩৩ নং ওয়ার্ডে ২৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি ৭৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৪ নং ওয়ার্ডে ৪৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ৫২ নং ও ৫৪ নং ওয়ার্ডে ৩৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ১৬ নং ওয়ার্ডে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও ৩ নং, ৫ নং, ১৫ নং, ১৭ নং এবং ২৩ নং ওয়ার্ডে ৩০ শতাংশ ব্রুটো ইনডেক্স পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রতিবছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মৌসুম পূর্ব, মৌসুম, মৌসুম পরবর্তী তিনটি জরিপ পরিচালনা করে আসছে। তারই অংশ হিসেবে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার কীটতত্ত্ববিদদের ২১টি টিমের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৯৯টি ওয়ার্ডে ২১টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়। প্রতি ওয়ার্ড ৮টি ব্লকে ভাগ করে দুটি টিম ৪টি ব্লকে ১৫টি করে প্রতি ওয়ার্ডে ৩০টি বাড়িতে জরিপ পরিচালনা করেন। ১০ দিনে ৯৯টি ওয়ার্ডে সর্বমোট ৩১৫২টি বাড়িতে সার্ভে করা হয়। তাছাড়া যেসব ওয়ার্ডে বাড়ির সংখ্যা বেশি ও এলাকা বড় সেগুলোতে ৩-৫টি টিমের মাধ্যমে জরিপ পরিচালনা করা হয়।
এক নজরে সংক্ষিপ্ত ফলাফল: জরিপ করা ৩১৫২টি বাড়ির মধ্যে ৪৬৩টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা ও পিউপা পাওয়া গেছে। তার মধ্যে বহুতল ভবন ৪২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, স্বতন্ত্র বাড়ি ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবন ২১ দশমিক ৬ শতাংশ, সেমিপাকা বাড়ি ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও খালি জায়গা ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। সুপারিশে বলা হয়েছে, কমিউনিটির জনগণকে সচেতনতার মাধ্যমে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার, যেহেতু ডেঙ্গু সারা বছর সংক্রমণ হচ্ছে ও সারা বছরের রোগ হিসেবে চিহ্নিত- তাই সেন্টিনাল সাইট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বছর কীটতাত্ত্বিক জরিপ কাজ পরিচালনা করা প্রয়োজনসহ ৪টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এবার ডেঙ্গু কিন্তু ভয়াবহরূপ নিতে পারে। যারা কয়েকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন তারাই বেশি মারা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সকলের সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
দেশের প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার স্থাপনের বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তিনি বলেন, হাসপাতাল কর্মকর্তা ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। জানিয়েছি, প্রতিটি হাসপাতালে যাতে ডেঙ্গু কর্নার আলাদা করে রাখা হয়। সেই ডেঙ্গু কর্নারে টিমও গঠন করে দেয়া হয়েছে। যেখানে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি ও পেডিয়াট্রিকস বিভাগের ডাক্তার একটি টিমে কাজ করবে। স্যালাইনের ঘাটতি যাতে কোনোভাবে না হয় সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা লোকাল উৎপাদক ও অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) সঙ্গে আলোচনা করেছি। হাসপাতালগুলো প্রয়োজনে যাতে নিজেরাই স্যালাইন কিনতে পারে সে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি ও মৃত্যুর হার বেশি থাকে। তাই এদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা যাতে সমন্বিতভাবে সেবা দিতে পারে সেইজন্যই টিম করে দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. শেখ দাউদ আদনান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।