এক.
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের দেশের প্রকৃত ইতিহাস শেখার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সর্তক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আমাদের অর্জনগুলোকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। গত শুক্রবার বাংলাদেশের স্থপতি ও তার পিতা শেখ মুজিবর রহমানের ১০২ তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি উপরোক্ত আহ্বান জানান। তার আহ্বানটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী। দেশের বিদ্যমান অবস্থায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
প্রায়শই আমি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এমনকি যুব বয়সের শিক্ষক শিক্ষিকা এবং রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হই। প্রশ্নটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তান হিন্দুস্থান সংক্রান্ত। সোজাসুজি তাদের প্রশ্নটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের অংশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে। এ দেশের মানুষ কেন বৃহৎ একটা দেশ ভারতের অংশ হয়ে না থেকে পাকিস্তানের অংশ হতে গেল। যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে তখন দেশ ভাগ হয়েছিল তা তো ব্যর্থ হয়েছে। চব্বিশ বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের জন্য যে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল তা কি সত্য নয়? ৪৭ সালে দেশ বিভক্ত না হলে তো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধ হতো না এবং লাখ লাখ লোক মারা যেতো না। তাদের এই প্রশ্নগুলো আমাকে বিব্রত করে। আমি বিস্মিত হই এই ভেবে যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমাদের ইতিহাস জানে না এবং এই না জানার পেছনে আমাদের, আমাদের সরকারের, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং বিজ্ঞজনদের ভূমিকা অত্যন্ত ব্যাপক। যে জাতির সন্তানেরা নিজেদের ইতিহাস জানে না সে জাতি টিকে থাকতে পারে না। তারা ভিন্ন জাতি ভিন্ন সংস্কৃতির একটি বড় দেশের লেজ হয়ে থাকতে ভালবাসে। কিন্তু নিজ ধর্ম-সংস্কৃতি সভ্যতা নিয়ে স্বাধীনভাবে ছোট দেশের মাথা হয়ে থাকা পছন্দ করে না। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে আমরা আমাদের ছেলে মেয়েদের আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে কোনও প্রকার শিক্ষা-দীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। ফলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের অবস্থা জানে না। তারা কী পরিস্থিতিতে দেশ ভাগ করতে বাধ্য হয়েছেন সে সম্পর্কেও তাদের কোনও ধারণা নেই। এমনকি বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কেও তাদের মধ্যে একটা অজ্ঞতা বিরাজ করছে। এই অজ্ঞতা মূর্খতার শামিল এবং এ জন্য আমরা নিজেরাই দোষী। আমার এই লেখা বিভ্রান্ত সেই তরুণদের জন্য যারা ইতিহাস জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। এখন অন্য প্রসঙ্গ।
নন্দিত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ মরহুম আবুল মনসুর আহমদ জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে মন্ত্রীত্ব করেছেন, দলকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন; দল ও দলীয় নেতাদের অবিমৃষ্যকারিতার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং চাবুক মেরে বিভ্রান্ত নেতৃত্বকে সোজা করার চেষ্টা করেছেন।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আধিপত্যবান্ধব নীতি-বৈশিষ্ট্য এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী কর্মকা-কে তিনি সহজভাবে নিতে পারেননি এবং দলীয় প্লাটফর্ম ও সংবাদপত্রের কলামে যখন যেখানে সম্ভব হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ শীর্ষক পুস্তকটি আবুল মনসুর আহমদের একটি অমর কীর্তি। এই পুস্তকে সন্নিবেশিত ৪২টি প্রবন্ধের প্রত্যেকটিতে আওয়ামী রাজনীতি আমাদের স্বাধীনতাকে কিভাবে বিপন্ন করে তুলেছিল তার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। প্রচুর রক্তপাত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতাকে জনাব আবুল মনসুর আহমদ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। আর তার যে স্বাধীনতার কনসেপ্ট ছিল তা শুধু ভৌগোলিক স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি পরাধীনতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। তার দৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা দৃষ্টিগ্রাহ্য। কিন্তু কৃষ্টিক বা সাংস্কৃতিক পরাধীনতা ধরাছোঁয়া ও দৃষ্টির ঊর্ধ্বে। তিনি বলতেন আমরা রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছি। অর্থনৈতিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ কেউ সমাজবাদী হয়েছেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য আমাদের কোন চেতনার লক্ষণই দেখা যায় না, যুদ্ধ করাতো দূরের কথা।
বাংলাদেশ হবার পর একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বুদ্ধিজীবী স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয়কে অভিনন্দিত করতে গিয়ে অতি উৎসাহে বলতে শুরু করেন যে, ১৯৪৭ সালে যে মানদ-ের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ তথা পাকিস্তান হিন্দুস্থান হয়েছিল তা তথা দ্বিজাতি তত্ত্ব ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। যারা এ ধারণায় বিশ্বাস করতেন জনাব আবুল মনসুর আহমদ তাদের তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন যে তারা আসলে স্বাধীনতার বন্ধু তথা পক্ষশক্তি নয়, শত্রু। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল বলেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের বর্তমান ভূখ-কে নিয়ে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ গঠন করতে পেরেছি। যদি দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়া না হয় তাহলে তার যৌক্তিক পরিণতি দাঁড়ায় অবিভক্ত ভারতের অংশ হয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আমাদের স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম অস্তিত্ব আর থাকে না। মরহুম আবুল মনসুর আহমদ তার রচিত ‘‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’’ শীর্ষক পুস্তকে এ কথাটি পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ইন্তিকাল করেছেন। ইতোমধ্যে গঙ্গা যমুনার অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বিভক্ত ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টির সুরাহা হয়েছে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, ভারতীয় অর্থ ও পরামর্শে পরিচালিত আঁতাতের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই বিষয়টি পুনরায় আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে এবং ১৯৪৭ সালে ধর্ম ও ধর্মানুসারীদের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের যৌক্তিকতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আর এই সুযোগেই বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলার ২১টি জেলা নিয়ে হিন্দুল্যান্ড গঠনের উদ্দেশে বঙ্গভূমি আন্দোলনের নেতারা বেনাপোল সীমান্তের ১০ কিলোমিটার দূরে বনগাঁওয়ে একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছিল। বাংলাদেশের তরফ থেকে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করা হয়েছিল বলে পত্র-পত্রিকায় কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গভূমি আন্দোলন আর ধর্মভিত্তিক ভারত বিভাজন বিরোধী প্রচারণার মূল লক্ষ্য অনুধাবন করা সম্ভবত খুব কঠিন কোনো কাজ নয়।
বাংলাদেশ সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন। এতে দেশবাসী হতবাক হয়েছিলেন। এরপর তিনি আর একটি ঘোষণা দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ টেনে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী তিনি বলেছেন যে, আমরা একই দেশের একই ধর্মের এবং একই সংস্কৃতির অনুসারী। তার এই বক্তব্যে দেশের মানুষ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। কেননা ব্যক্তিগতভাবে তিনি হিন্দু অথবা মুসলমান না হতে পারেন কিন্তু এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্ম এবং সংস্কৃতি ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম-সংস্কৃতি থেকে আলাদা। মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশের নেতা বা মন্ত্রী হয়ে তৌহিদপন্থী ৯০ ভাগ মুসলমানকে তিনি মুশরিকদের সঙ্গে বিলীন করে দিতে পারেন না। এদেশের মানুষ ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। হিন্দুরা হিন্দুদের ধর্মীয় চর্চা করুক এবং মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুক এটাই তারা চায়। প্রয়াত আশরাফের এক ধর্ম, এক সংস্কৃতি, এক দেশনীতি মেনে নিলে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর থাকে না। তাকে ভারতের সাথে এক হয়ে যেতে হয়। এ ধরনের চিন্তার মানুষ আরও রয়েছে। ২০১১ সালে বিশেষ স্থানে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মতিউর রহমান নামে আদালতের একজন তদন্তকারী কর্মকর্তার একটি তথ্য আমাকে হতবাক করেছে।
তিনি আমাকে দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন এবং তাকে শুধু অসার নয় মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত করারও চেষ্টা করেছেন। পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানভুক্তির ওপর প্রশ্ন তুলে তিনি বলতে চেষ্টা করেছেন যে, চৌধুরী রহমত আলীর পাকিস্তান ফর্মুলায় পূর্ববাংলা ছিল না, তিনি বেগমগঞ্জের জয়াগে গান্ধী আশ্রমের প্রসঙ্গ টেনে রামগঞ্জের মুসলমান কর্তৃক গান্ধীর ছাগল জবাইয়ের ঘটনার উল্লেখ করে বৃহত্তর নোয়াখালী ও বর্তমান ফেনী জেলার একটি থানার (উপজেলা) নাম ছাগলনাইয়া রাখার একটি তথ্য (?) আমাকে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে আমার নিজ জেলা বৃহত্তর নোয়াখালীর রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, রামগতি, সুধারাম, সেনবাগ, পরশুরাম প্রভৃতি উপজেলার হিন্দু নাম প্রমাণ করে যে, এসব এলাকা হিন্দু মেজরিটি ছিল। দেশ বিভাগের আগে মুসলমানরা বেশিরভাগ হিন্দুদের মেরে-কেটে এবং ভারতে তাড়িয়ে দিয়ে এলাকাকে মুসলিম মেজরিটি বানিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করেছে। গান্ধী জয়াগ এসেছিলেন শান্তির দূত হয়ে। তার এই তথ্যটি শুনে ঐতিহাসিকদের কেউ যদি আত্মহত্যা করেন আমি বিস্মিত হবো না। তার কথায় আমি বিস্মিত হয়েছি এবং এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনি। যে দেশের মানুষ নিজ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানে না, বিশেষ করে যারা গুরুত্বপূর্ণ ও নীতি-নির্ধারণী পদে আছেন। এরা দেশের মানুষকে বিদেশের গোলামে পরিণত করতে পারেন। এখানে পূর্ব পুরুষদের দূরদর্শিতার প্রশ্নটি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। বহুদিন আগে একটি ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম, লেখকের নাম আমার মনে নেই। কবিতাটির কয়েকটি চরণ ছিল এ রকম ‘ We call our fore fathers fool so wise we grow, our wiser sons, no doubt, would call us so.
অর্থাৎ আমরা যতই প্রজ্ঞাবান হই ততই আমাদের পূর্ব-পুরুষদের বোকা বলি, আমাদের প্রজ্ঞাবান সন্তানরাও নিঃসন্দেহে একদিন আমাদের তাই বলবে। বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইতিহাস পড়ানো হয় না। যা পড়ানো হয় তা হচ্ছে ইতিহাসের বিকৃত খ-াংশ। এ থেকে এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অতীত জানা যায় না। বৃটিশ ভারতে রাজশক্তি ও তার সহযোগী হিন্দুদের দ্বারা নিগৃহীত অনেক মুসলমানের বংশধররা এখন নিজেদের মুসলমান পরিচয় দেয়াকে অপমানকর মনে করেন। তাদের দৃষ্টিতে এই শব্দটি সাম্প্রদায়িক, যদিও হিন্দুরা নিজেদের হিন্দু হিসেবে পরিচয় দেয়ার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার কোনও উপাদান খুঁজে পান না। অবশ্য এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেননা উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাতেই মীর জাফরের জন্ম হয়েছিল। তার বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলাই প্রথম বৃটিশ বেনিয়া শক্তির পদানত হয়েছিল। এই মীর জাফরের বংশধররা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এই বাংলার মুসলমানরা এক সময় শৌর্য-বীর্য, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে সমাজের শীর্ষে অবস্থান করতেন। বৃটিশের পদানত হয়ে তারা তাদের সকল অবস্থান থেকে বহিষ্কৃত হন এবং অর্ধশতাব্দী যেতে না যেতেই ভিস্তিওয়ালা আর কাঠুরিয়ার জাতিতে পরিণত হন।
যারা বাংলা এবং বাঙালি বলতে অজ্ঞান তাদের অনেকেই বাংলার ইতিহাস জানেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। জানলেও এসব লোক তা স্বীকার করতে চান না। বৃটিশ শাসনামলে নানাভাবে পর্যুদস্ত ও বঞ্চিত মুসলমান হিন্দুদের গোলামে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বত্র ছিল তারা অবহেলিত। জমিদারদের শতকরা ৯৫ ভাগই ছিল হিন্দু এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিকও ছিলেন তারাই। বর্ণ হিন্দুদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘকাল ধরে বাংলার মুসলমানরা সুশাসনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তাদের এই দাবির প্রেক্ষাপটে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করেন। মুসলমানদের সুবিধাকে সামনে রেখে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা করার বৃটিশ এই সিদ্ধান্তকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথসহ ভারতের বর্ণ হিন্দুরা মেনে নিতে পারেননি।
তারা এর মধ্যে মুসলিম জাগরণ ও পুনরুজ্জীবনের আভাস পান এবং অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য তারা আন্দোলন শুরু করেন। স্বদেশী আন্দোলন ছিল এই লক্ষ্যেই পরিচালিত। আরএসএস তাদের মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র বুননে স্বদেশী আন্দোলনকেই ব্যবহার করেছে। স্বদেশী আন্দোলন ও হিন্দু মহাসভার চাপে পড়েই মাত্র ছয় বছর পর ১৯১১ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, অবিভক্ত ভারতে পরিচালিত ১৯৪১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী নিখিল ‘বাংলার’ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী ছিল মুসলমান। তখনকার দিনে বিহার ও উড়িষ্যাকেও বাংলার অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হতো। আদমশুমারীর তথ্যানুযায়ী বাংলার মোট জনসংখ্যার ৫৩.৪ শতাংশ ছিল মুসলমান, অবশিষ্ট ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান। কিন্তু সরকারি চাকরি-বাকরি, শৃঙ্খলা বাহিনী ও আর্মিতে মুসলমানের সংখ্যা ছিল দেড় থেকে দুই শতাংশ। পূর্ববাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশের বেশি। শিক্ষকতা পেশায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ছিল সাত শতাংশেরও কম। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া হিন্দুদের হাতে, তখনকার দিনে গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত গ্রামীণ সমবায় সমিতি ও সমবায় ব্যাংকগুলোর নেতৃত্ব ছিল তাদের হাতে। মহাজনী ব্যবসাও হিন্দুরা নিয়ন্ত্রণ করতো এবং দরিদ্র মুসলিম কৃষক প্রজারা হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের কাছ থেকে বাধ্য হয়ে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সর্বস্বান্ত হতো। এর কোনও প্রতিকার ছিল না।
সুবে বাংলা ছিল পাঁচটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। এই বিভাগগুলো ছিল (১) প্রেসিডেন্সি বিভাগ : এর অধীনে ছিল ২৪ পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, যশোর, খুলনা জেলা ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি শহর নিয়ে মোট ৬টি জেলা (২) বর্ধমান বিভাগ : এর অধীনে ছিল ৬টি জেলা যথাক্রমে হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও বীরভূম জেলা (৩) রাজশাহী বিভাগ : এর অধীনে ছিল ৮টি জেলা তথা রাজশাহী, পাবনা, মালদহ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং (৪) ঢাকা বিভাগ : ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও বরিশাল- এই চারটি জেলা নিয়ে এই বিভাগটি গঠিত ছিল। (৫) চট্টগ্রাম বিভাগ : এই বিভাগের অধীনে ছিল ৪টি জেলা এবং এগুলো হচ্ছে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলা।
বিভাগওয়ারি বিভাজনের বাইরেও অবিভক্ত বাংলা সন্নিহিত কিছু অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী লোকের আধিক্য ছিল এবং এদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। আসামের সিলেট জেলা, দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও কুচবিহার এবং বিহারের মানভূম ও সিংহভূম এলাকার বাসিন্দারা বাংলাভাষী ছিল।
প্রশাসনিক বিভক্তি ছাড়াও বেসরকারিভাবে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশটি তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হচ্ছে পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা ও উত্তর বাংলা। প্রেসিডেন্সি ও বর্ধমান বিভাগ নিয়ে পশ্চিম বাংলা, রাজশাহী বিভাগ নিয়ে উত্তর বাংলা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ নিয়ে পূর্ব বাংলা গঠিত ছিল। এ প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার সবকটি জেলা উত্তর বাংলার ৭টি জেলা এবং পশ্চিম বাংলার দু’টি জেলা তথা মোট ১৫টি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশে পড়েছে। এর সাথে আসামের সিলেট জেলা যুক্ত হয়ে মোট ১৬টি জেলা নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর এই অঞ্চলটিই এখন বাংলাদেশ নামে পরিচিত। তিন বাংলার পাঁচটি বিভাগের ২৮টি জেলার মধ্যে ১৫টি জেলা প্রথমে পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের অংশ হবার একমাত্র মানদ- ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস। এই অঞ্চলের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ পাকিস্তান তথা মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। পশ্চিম বাংলার প্রেসিডেন্সি বিভাগের দু’টি জেলা যশোহর ও খুলনা ঐ সময়ে পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। এই বিভাগের খুলনা জেলা ছিল হিন্দু প্রধান এবং মুর্শিদাবাদ ছিল মুসলিম প্রধান। আবার মুর্শিদাবাদ শিল্পসমৃদ্ধও ছিল। কিন্তু তথাপিও হিন্দু প্রধান জেলাটি ভারতে এবং মুসলিম প্রধান জেলাটি পাকিস্তানের অংশ না হবার পেছনে হিন্দু নেতৃত্বের একটি কারসাজি কাজ করেছিল যা ভারত সরকারের প্রকাশিত ফারাক্কা দলিলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, ভারতের স্বার্থে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার উৎসমুখ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলা তাদের প্রয়োজন। এর বিনিময়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ খুলনা জেলাকে তারা পাকিস্তানকে দিতে চান। এই বিষয়ে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে ভারতীয় কংগ্রেসের সিনিয়র নেতারা ব্যাপক দরকষাকষি করেন এবং শেষ পর্যন্ত এই বিনিময়ে তারা রাজী হন। একইভাবে অবাঙালী অভিবাসীদের বাদ দিলে প্রেসিডেন্সি জেলা কলকাতাও ছিল মুসলিম প্রধান এবং এই শহরটিও ঐ সময়ে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা তা করতে দেননি। ঐ সময়ে মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের যদি অংশ হতো তাহলে আজ এই অঞ্চলগুলো বাংলাদেশের অংশই থাকতো। (চলবে)