বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলার প্রকৃতি, নিসর্গ এবং আর্থসামাজিক জীবনযাপনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সজিবতার, প্রেম ভালোবাসা ও দ্রোহের রূপকার ছিলেন। মাত্র বাইশ বছরের সৃজনশীল জীবনে সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তার বলিষ্ঠ পদচারণা ছিল বিস্ময়কর। তিনি আধুনিকদের আধুনিক ছিলেন দৃষ্টিভঙ্গিতে, বাকপ্রতিমায় শব্দ সমাহারে অবিস্মরণীয় প্রতিভার অধিকারী, সঙ্গীতে মৌলিক সুরস্রষ্টা, যত দিন যাচ্ছে তত তিনি আমাদের কাছে বিস্ময়ের বিস্ময় হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছেন। এ বছর তার ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং মিডিয়া নজরুলকে নতুন আগ্রহে নতুন চেতনায় স্মরণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। বাস্তবিক সর্বহারা নজরুল তার চেতনা দীপ্তিতে দীপান্বিত হয়ে উঠছেন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সর্বহারার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা তার সাহিত্যে সমাজের সর্বহারা শ্রেণীর মানুষের কথা ঠাঁই পেয়েছে, প্রতিফলিত হয়েছে তাদের জীবনদর্শন। বস্তুত বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে নজরুল এমন একজন বিরল ব্যক্তিত্ব যার লেখনীতে কুলি, মজুর, ভিখারি প্রমুখ নিপীড়িত অসহায় মানুষের কথা বাঙময় হয়ে উঠেছে। মানবতাবাদের কবি নজরুল সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের প্রতি ছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধাশীল, বিশেষ করে নিগৃহীতজনদের প্রতি সবিশেষ সহানুভূতিশীল-তার রচনা পাঠ করলে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
কিন্তু এ কথা চরম সত্য, এই সর্বহারার কবি নিজে ছিলেন একজন সর্বহারা। সমাজের কাছে থেকে, পরিবেশের কাছ থেকে, নিয়তির কাছ থেকে যে সহানুভূতিশীল নিয়ে সুদীর্ঘ ৭৭টি বছর জীবন সংগ্রাম চালিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছেন তার সুষ্ঠু মূল্যায়ন করলে এ কথা প্রতীয়মান হবে, তার ভাগ্যবিপর্যয় তাকে কত করুণ পরিস্থিতির শিকার হতে বাধ্য করেছিল। জীবনযুদ্ধের এ আত্মঘাতী সংগ্রামে তিলে তিলে দগ্ধ হতে হতে যিনি অবশেষে নিঃশেষ হলেন তিনি নজরুল ইসলাম। তার জীবন ইতিহাস একজন লাঞ্ছিত, ভাগ্যাহতের জীবন ইতিহাস।
সর্বহারা নজরুল জন্মেছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে। সে পরিবারে ভাইবোন জন্মে কেউ বেশি দিন বাঁচতেন না। তার নাম তাই রাখা হয়েছিল ‘দুখু মিয়া’ দুঃখের শিশু। নজরুলের এ বাল্যনাম তার সারা জীবনের করুণ ট্র্যাজেডির সার্থক পরিচয় বহন করে। দুঃখ-দারিদ্র্য সঙ্গী করে যিনি কালাতিপাত করে গেলেন তার পক্ষে বোধকরি এ কথা বলা সাজে, হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান।’ শৈশবকালে পিতাকে হারাতে হয়েছিল তাকে। ১০ বছর বয়সে জীবিকার্জনে মক্তবে শিক্ষকতা, গ্রামে মোল্লাগিরি ও মাজার শরিফের খাদেমগিরি গ্রহণ করতে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে লেটোর দলের পালাগান রচনার কাজও তাকে করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, নজরুলের দুরন্তপনা তার মনকে বিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেনি। এটা যথাযথ কারণ নয়, দারুণ অর্থসঙ্কট এবং পারিবারিক খরচ সঙ্কুুলান করার কাজ তাকে শিক্ষায়তনে বিদ্যাচর্চার ভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেছে।
১৯১১ সালে বর্ধমানের মাথরুন হাইস্কুলে অত্যন্ত স্বল্পকাল বিদ্যাভ্যাস করতে পেরেছিলেন তিনি। এর পরপর আমরা তাকে জনৈক রেলওয়ে গার্ড সাহেবের বাড়িতে বাবুর্চিগিরি করতে দেখতে পাই। তাকে পাই হুগলির এম বখশের রুটির দোকানে মাত্র পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি করতে। জীবিকার্জনে যাকে নিম্নমানের কাজে এত অল্প বয়সে নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল, তার তৎকালীন কুলীন ভদ্র সমাজ চালিত শৌখিন বিদ্যায়তনে পাঠ কার্য চালাবার অবসর কোথায়? ময়মনসিংহের কাজীর শিমলা গ্রামনিবাসী কাজী রফিজুল্লার বাড়িতে থেকে দারিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে পড়ার সৌভাগ্য তার হলেও তিনি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। গুহসন্ন্যাস, ভাগ্যতাড়িত এ হতভাগ্য ছেলেটির সারা শরীরে তখন প্রচণ্ড আগুন। কোনো ¯েœহ পারিবারিক গণ্ডি থেকে নজরুল পাননি। পারিবারিক অর্থসঙ্কট দূর করতে তাকে কাজের চেষ্টা করতে হতো। আর্থিক দৈন্য এবং জীবিকার্জনের এক প্রবল তাড়না নজরুলকে ঘরের বের করেছিল।
১৯১৯ সালে নজরুল ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে সৈনিক বৃত্তি গ্রহণ করেছিলেন। হাবিলদার নজরুলের মনে এক নিদারুণ অশান্তি ছিল। স্বদেশ প্রেমিক হাবিলদার এ কথা ভেবে দুঃখ পেতেন যে, তিনি লড়ছেন বিদেশী শাসিত তার স্বদেশের সম্ভ্রম রক্ষায়। এ লড়াইয়ে লাভ? দেশকে কিভাবে মুক্ত করা যাবে এ চিন্তা তাকে পেয়ে বসেছিল। সংশ্লিষ্ট কর্মের সাথে কর্মী নজরুলের এই মানসিক বিরোধ বাধ্য করেছিল তাকে এক হাতে কলম আর এক হাতে রাইফেল ধরতে। তিনি লিখতে শুরু করলেন। তার লেখা প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’। এটি মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার ১৩২৬ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশিত হয়েছিল। নজরুলের প্রথম সাহিত্যিক রচনা এ ‘মুক্তি’ কবিতাকে পেপার বাসকেট ঘুরে আসতে হয়েছিল। কবিতাটি প্রথম প্রথম সম্পাদকের মনোপূত হয়নি। পরে পেপার বাসকেট থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ওটি ছাপানো হয়েছিল। ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’কে নজরুলের আত্মকাহিনী বললে অত্যুক্তি হয় না। একটি অভিজাত পরিবারের তরুণীর সাথে নিম্নপদস্থ সৈনিকের প্রেম রচনার স্বপ্ন নিছক অমূলক মাত্র। বলাবাহুল্য, নজরুলের জীবন চিরকাল এ অব্যক্ত অসম্ভব প্রকাশকে বেদনাকে সঙ্গী করে গড়ে উঠেছে।
নজরুলের প্রথম রচনা ‘মুক্তি’ প্রকাশের মতো ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিল তার পরবর্তীকালের সব সাহিত্যিক রচনা। ১৯২০ সালের এপ্রিল মাসে বাঙালি পল্টন থেকে ফিরে এসে নজরুল পুরোদমে লেখা শুরু করেন। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই রোগাক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত ২৩ বছর তিনি বিরামহীন লেখনী চালনা করেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস, গল্প, একাঙ্কিকা, নাটিকা, গানের স্বরলিপি, রাগপ্রধান গান। এ সময়ে তিনি বিদ্যুৎবেগে লেখনী চালিয়ে আমাদের যা উপহার দিয়েছেন তার সব কয়টি আমাদের দ্বারে পৌঁছতে পারেননি। তার অনেক কবিতা, গান আজও অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। সংগৃহীত হয়নি অনেক কিছু। সমসাময়িককালে অনেক স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি তার লেখা নিজের নামে চালাতেও কসুর করেনি। নজরুল এমন একজন কবি, যিনি কলম ধরালে লিখতে পারতেন এবং যা একবার লিখতেন তা আর সংশোধন করতেন না। পথে-ঘাটে, যেখানে যে অবস্থায় থাকতেন, লিখতেন। যে চাইত তাকে লেখা দিতেন। তার এ সরল উদার ব্যস্ততার সুযোগ অনেকে পুরোপুরিভাবে নিতেন। প্রকাশকরা তার অগোচরে বেশিসংখ্যক বই ছাপিয়ে মুনাফা লুটতেন। বন্ধুমহল তাকে নিয়ে ফুর্তি করেছে। তার বইয়ের রয়্যালিটি অর্জিত টাকা বেপরোয়াভাবে খরচ করিয়েছে, মজা লুটে খেয়েছে অথচ কবিকে অধিকাংশ সময় উপোস থাকতে হতো। অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে সে খোঁজখবর খুব কমসংখ্যক বন্ধুবান্ধব রেখেছেন।
বাকরুদ্ধ নজরুলের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। অনেক দুঃখ ভোগ করে শুশ্রƒষার অভাবে, সুচিকিৎসার অভাবে তাকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে জীবনের শেষ ৩৪ বছর বাকরুদ্ধ জীবনে। ১৯৫২ সালে নজরুল নিরাময় সমিতি নামে একটি ট্রাস্ট গঠিত হলেও অসুস্থ কবির পরিচর্যার এই ট্রাস্ট ব্যর্থ হয়েছিল বলা চলে। ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের সুপারিশে সরকারও কবিকে ভাতা দিত। এ দুই সরকারের ভাতা যার সম্মিলিত পরিমাণ টাকা (প্রাথমিক কালে এক হাজার টাকার বেশি ছিল না) তার চিকিৎসার খরচ-পথ্যাদি ক্রয় ও যাবতীয় খরচ নির্বাহের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। প্রকাশকরা তাকে যে রয়্যালিটি দিতেন তা তার ছেলেরা উঠাতেন এবং সেগুলো কবির জন্য ব্যয় প্রসঙ্গে অনেক অভিযোগ বিভিন্ন সময় শোনা গেছে।
কবির ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবি-সাহিত্যিকরা নানারকম অভিযোগ তুলে তাকে আর্থিক কষ্টে ফেলে অসহায় করে তুলেছিলেন। তবু তিনি উভয় সম্প্রদায়ের মিলনে লিখেছেন। অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁকে নজরুল একবার লিখেছিলেন : ‘বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিরোধভাব প্রায়ই লক্ষ করা যায়। আমি এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতিভাব বজায় দেখিতে চাই। আর তাই আমি আমার রচনায় হিন্দু দেব-দেবীর নাম ব্যবহার করি, আবার আরবি ফারসি শব্দও ব্যবহার করি। হিন্দু দেব-দেবীর নাম দেখিয়ে মুসলমানদের এবং আরবি ফারসি শব্দ দেখিয়ে হিন্দুদের মনঃক্ষুণœ হওয়া উচিত নয়।’ ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি নজরুলের প্রথম সুখময় বিবাহ-স্মৃতি ছিল দুঃখময়। তিনি হলেন অসহায় ভাগ্যের ও নিয়তির ক্রীড়নক। কুমিল্লার আকবর আলী খাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত বিয়ে অনুষ্ঠান থেকে নজরুল ইসলামকে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরতে হয়েছিল, তারপর তাড়াহুড়ো করে বিয়ে হলো প্রমিলা সেন গুপ্তার সাথে। এ বিয়ে ব্যাপারটি হলো নজরুল জীবনের ট্র্যাজেডি। কবি লিখলেন, ‘সাজিয়াছি বর মৃত্যুর উৎসবে’। সারাজীবন এ মৃত্যুময় যন্ত্রণা নজরুলকে টেনে-হিঁচড়ে বেড়িয়েছে। তবু দুই সম্প্রদায়ের মিলনে কবিতা লিখেছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হিন্দু-মুসলমান মিলনের প্রচেষ্টাকারী এ মহাত্মার প্রচেষ্টা ভিন্ন অর্থে বহন করে তার প্রতিভাসূর্য ম্লান করতে চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। অথচ তিনিই প্রথম লিখেছিলেন ‘হিন্দু মুসলমান একটি বৃক্ষের দু’টি পাতা’।
নজরুলের জীবন সংসার অবহেলিত ছিল না, তার সাহিত্যের মূল্যায়নেও অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়ে আসছে। নজরুল সাহিত্যের একজন বিদগ্ধ সমালোচক দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কমরেড মোজাফফর, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সুফি জুলফিকার হায়দায় নজরুলের শুধু স্মৃতিকথা লিখে গিয়েছেন, রচনাবলির মূল্যায়ন করেননি কেউ’। কথাটি চরম সত্য। এতদিন নজরুলকে নিয়ে যত বই বা আলোচনা লেখা হয়েছে, তা সব তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, তার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা প্রকাশ প্রাধান্য পেয়েছে সেসব লেখায়। নজরুল সাহিত্যের প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়নি আজও। উদ্যোগ তেমন একটি গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। উভয় বাংলার নামমাত্র গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান তার নামে স্থাপিত হলেও এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠানই রয়ে গেছে। নজরুল সাহিত্যের প্রকৃতি, স্বরূপ, বিশেষত্ব নিরূপণে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়নি। বলাবাহুল্য, প্রকৃত নজরুল চর্চা আজও শুরু হয়নি। এখনো আমরা শুধু জয়ন্তী অনুষ্ঠানে তার সাহিত্যকে আবৃত্তি ও গান গেয়ে কোনোরকম দায় সারি। তার ভেতরে প্রবেশ করে মর্মোদ্ধারের কোনো প্রচেষ্টা শুরু করিনি। নজরুল প্রায় চার হাজারের বেশি গানের রচয়িতা। কিন্তু এসব গানের প্রকৃত ও নির্ভরযোগ্য সঙ্কলন প্রকাশ করা হয়নি। বিভিন্ন সময় নজরুল গীতির সুরারোপে বিকৃতির অভিযোগ শোনা যায়। নজরুলগীতির স্থায়ী স্বরলিপি প্রণয়ন করা বাঞ্ছনীয়। নজরুল গীতির একনিষ্ঠ সাধক ফিরোজা বেগম ও অন্যদের সহযোগিতায় বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘স্বরবিতানের’ মতো নজরুল গীতির স্বরলিপি নজরুল একাডেমি কিংবা কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ করা উচিত এবং বাঞ্ছনীয় মনে হলেও আজও তেমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। আর এমনিভাবে তার বিরাট অবদান আমরা দিনে দিনে অবহেলায় অবজ্ঞায় হারাতে বসেছি।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক