নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে পূর্ব এবং পশ্চিমবাংলায় মুসলমানদের আনুপাতিক সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে। তাদের ভূমিকা নিয়ে করা হয়েছে লুকোচুরি। একই সাথে ইসলামকেও এ অঞ্চলে মানুষের কাছে গুরুত্বহীন করে দেখানো হয়েছে। ক্লাস সেভেনের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় যে আলোচনা করা হয়েছে তাতে ইসলামের সাথে বাংলার আপামর জনতার সম্পর্ক ছিল না বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এই অঞ্চলে দলে দলে লোকজন ইসলাম কবুল করে যেভাবে মুসলমানদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই হিসাবও এখানে সুকৌশলে আড়াল করা হয়েছে।
ক্লাস নাইনের বইয়ের ৩৬ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত আলোচনায় একটি বিষয়কে জোরালোভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে আর সেটি হলো পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের বানানো হয়েছে সংখ্যালঘিষ্ট। বইয়ের আলোচনায় বলা হয়েছে এ রকম:- ‘সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সাল। শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। ধর্মের নামে যে প্রক্রিয়ায় বাংলাকে ভাগ করা হয়েছে তা নিয়ে তিনি ছিলেন ক্ষুুব্ধ ও অসন্তুষ্ট। এ বিভাজনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান, হিন্দুসহ অন্যদের নিয়ে তিনি গভীর উদ্বিগ্ন ছিলেন’। এই সময়ে তিনি ‘গণতান্ত্রিক ও যুবলীগ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তি বজায় রাখার জন্য কাজ শুরু করেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, এই প্রতিষ্ঠানের ‘একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা, যাতে কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামায় দেশ ত্যাগ না করে। যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমুনি, তার জন্য চেষ্টা করা’।
এই বর্ণনায় যেসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তার বিপরীতে সঠিক ইতিহাস হচ্ছে, তখন আদমশুমারি রিপোর্ট অনুসারেও এই দেশে মুসলিমরা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। এ বিষয়ে ড. জয়া চ্যাটার্জী ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সালের হিন্দু মুসলিম সংখ্যার একটি পরিসংখ্যান নিয়ে ‘Bengal Divided: Hindu Communalism and partition’ এই বইয়ের ২৪৫ পৃষ্ঠায় দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় তখন হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ৩৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ, ত্রিপুরায় হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ মাত্র। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার ঢাকা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, খুলনাসহ বর্তমান বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই মুসলিমরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনি লিখেছেন, তখন পূর্ববঙ্গের ম্যাক্সিমাম মানুষ ছিল মুসলিম হিন্দুরা সংখ্যায় ছিল খুবই কম।
ক্লাস নাইনের বইয়ের বর্ণনায় অপর একটি আলোচনায় ১৯০৫ সালের বঙ্গবিভাগকে সব সময়ই দেখানো হয়েছে নেগেটিভাবে। অথচ এই বাংলা ভাগ ছিল পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির একটি বন্দোবস্ত। এটা কলকাতার বাবুরা সহ্য করতে পারেনি। এর বিরুদ্ধে তারা একত্রে সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই বয়ান আমাদের কোমলমতি শিশুদের শেখানো হচ্ছে। অথচ পূর্ববঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন ছিল বাংলা ভাগের প্রতি। তারা এই বিভাজনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে লেখক গিরিশ চন্দ্র সেনের কথাও এখানে প্রনিধানযোগ্য। তিনি হিন্দু ধর্মের হলেও বঙ্গভঙ্গকে তিনি সমর্থন করেছেন। কারণ এর ফলে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের উন্নতি হবে। গিরিশচন্দ্র সেন লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের কথা ছাড়িয়া দেই। বাঙালিদের উন্নতি দর্শন অনেকের চক্ষুশূল হতে পারে। কলকাতা অঞ্চলের পূর্ববঙ্গ নিবাসী কৃতবিদ্য লোকরা কোনো অফিসে তাহাদের কর্তৃক বাধা পাইয়া সহজে প্রবেশ করিতে পারেন না । এখানকার কেরানিগিরি প্রভৃতি কাজ এক প্রকার এখানকার লোকেরই একচেটিয়া হইয়া রহিয়াছে। গিরিশ চন্দ্র সেন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখদের প্রচারকে দুঃখব্রত বলেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলা বিভাগ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পূর্ববঙ্গের জন্য কল্যাণকরও ছিল বটে।
অন্য একটি সভার ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতো। বাখরগঞ্জে আরাকান্দিতে জমিদার রাজেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সভাপতিত্বে নমশূদ্রদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় । তারা বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছিল মুসলমানদের যেসব অধিকার আছে নমশূদ্রদের সেইগুলো দেয়া হোক। কারণ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অত্যন্ত নিপীড়ন চালায় তাদের ওপর এবং তাদের থেকে মুসলমানরা নমশূদ্রদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। উচ্চবর্ণদের সরকার বিরোধী আন্দোলনে তারা নেই এবং মুসলমান ভাইদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে তারা কাজ করবে। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণের জন্য ।
তথ্যসূত্র : Bandyotadhyay, s., Caste and politics in East Bengle: The Namasudras and The Anti-Partition Agitation, 1905-1911, Centre for South East Asian Studies Calcutta University 1981)
অপর এক বর্ণনায় ক্লাস নাইনের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১১৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ইংরেজরা ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগ করে ফেরত চলে যায় তখন এখানকার রাজনীতিবিদরা বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে অনুসরণ না করে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে নতুন রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিবিহীনভাবে বাংলা অঞ্চলের পৃর্ব অংশের নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান। বাংলা ভূখণ্ডের আদি নাম বঙ্গ হারিয়ে যায় কিছু সুবিধাবাদি রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতির অন্ধকারে। (ক্লাস সেভেন পৃষ্ঠা ৮৫)। পাকিস্তান ছিল মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের যে দাবি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ তুলে ধরেছিল তারই বাস্তব রূপায়ণ। ফলে এর শাসকরা চালিয়ে পাকিস্তানকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা চালায়।
যদিও প্রকৃত ইতিহাস হচ্ছে তখনকার পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মুসলিম পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব নেতা পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এর জীবন্ত এক দলিল। তাছাড়া বাংলার জাতীয় নেতা তাজউদ্দিন আহমেদের ডাইরি পড়লে বুঝা যায়, পাকিস্তান পাওয়ার পর পূর্ব বাংলার সবাই খুব উল্লসিত হয়ে পড়েছিল। এমনকি এই দেশের হিন্দুরা তা মেনে নিয়েছিল খুশি মনে। স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রায় এক লাখ হিন্দু ও মুসলমান। সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদের ডাইরি, (প্রতিভাস, জানুয়ারি, ২০১৪) প্রথম খণ্ড, (পৃষ্ঠা ৪৯-৫০)।