পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে মাদারীপুরে বিপুল পরিমাণ জমি কেনা হয়েছে। মাত্র ৫৯৪ দিনে জীশান মীর্জার নামে কেনা হয়েছে ৯০১৬ শতাংশ বা ২৭৩ বিঘা জমি। এসব জমির রেজিস্ট্রি মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ টাকা। বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আর মাদারীপুরের জমিগুলো কেনা হয়েছে ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামের এসব সম্পদের তথ্য উঠে আসে। দুদক বেনজীরের এসব সম্পদ জব্দ তালিকায় এনেছে। গতকাল রবিবার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের নির্দেশে এসব সম্পদ জব্দ করে দুদক।
মাদারীপুরের সম্পদের বাইরে রাজধানীর গুলশানের র্যাংকন আইকন টাওয়ারের চারটি ফ্ল্যাট, সাভারের তিন কাঠা জমি, পরিবারের পাঁচ সদস্যদের নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানে থাকা মালিকানা জব্দের আদেশ দেন আদালত।
আদালতে উপস্থাপন করা দুদকের গতকালের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে ১১৪টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। মাদারীপুর জেলার রাজৈর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৬০ নম্বর সাতপাড়া ডুমুরিয়া মৌজায় এসব জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে কেনা উল্লিখিত দলিলগুলোতে জমির পরিমাণ প্রায় ৯০১৬ শতাংশ বা ২৭৩ বিঘা।
এসব জমির ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। যদিও বাস্তবে এসব জমির ক্রয়মূল্য দলিলে দেখানো মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে মাদারীপুরে গড়া সাম্রাজ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেনজীর পুলিশের আইজি থেকে অবসরে যাওয়ার ঠিক আগের ৫৯৪ দিনে বিপুল এ সম্পদ কিনেছেন। এ হিসাবে তিনি প্রতিদিন গড়ে ১৫.১৬ শতাংশ জমি কিনেছেন। তিনি অবসরে যান ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
আর মাদারীপুরের জমিগুলো কেনেন ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত। জমি কেনা শুরু করেন ২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারিতে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর আটটি জমি কেনেন। এসব জমির পরিমাণ ৬৩০ শতাংশ। একই বছরের ২১ নভেম্বর আটটি জমি রেজিস্ট্রি করা হয়। ২৭ ডিসেম্বর করা হয় সাতটি জমি রেজিস্ট্রেশন। এভাবে মাত্র দেড় বছরেরও কম সময়ে ১১৪টি দলিলে ৯০১৬ শতাংশ জমি কেনা হয় জীশান মীর্জার নামে। ২০২১ সালে কেনা হয় ৫০২৬.০৯ শতাংশ জমি। ২০২২ সালের সাত মাসে ৩৯৮২.৪৭ শতাংশ জমি কেনা হয়।
মাদারীপুরের বিপুল এ সম্পদের বাইরে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর, জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা জব্দ করা হয়েছে। স্ত্রী ও মেয়ের নামে গুলশান ১ নম্বরে র্যাংকন আইকন টাওয়ারের ৯ হাজার ১৯২.৭৮ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট জব্দ করা হয়। এসব ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ২২ কোটি টাকা হলেও মূল্য দেখিয়েছেন দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ছোট মেয়ে নাবালক হওয়ার তার পক্ষে বেনজীর কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট। সাভারের মৈস্তাপাড়া মৌজার তিন কাঠা জমিও জব্দ করা হয়েছে।
এর আগে আদালতের আদেশে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, তিন মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীরের নামে থাকা ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। এসব দলিলে মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৪৬.৩০ বিঘা, যার দলিলমূল্য দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব জমির দাম অন্তত পাঁচ থেকে সাত গুণ বেশি বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া তাঁদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে সাধারণ হিসাব, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ডসহ ৩৩টি হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। তবে এসব ব্যাংক হিসাবে কী পরিমাণ অর্থ সংরক্ষিত আছে তা জানা যায়নি। আদেশে বলা হয়েছে, এসব ব্যাংক হিসাব থেকে কোনোভাবেই টাকা উত্তোলন করা যাবে না। দুদকের বিধি মতে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের অধীনে বেনজীরের হিসাবগুলো অবরুদ্ধ থাকবে।
নতুন করে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদ জব্দের আদেশ চাওয়া নিয়ে আদালতে যুক্তি তুলে ধরে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর আদালতকে বলেন, বিভিন্ন জেলায় বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এরপর নতুন করে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে যেসব অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তা বিক্রি ও হস্তান্তরের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের চেষ্টা করছেন বলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। অনুসন্ধান বা মামলা নিষ্পত্তির আগে বর্ণিত সম্পত্তি হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের ক্ষতির কারণ রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ নামে, স্ত্রী ও মেয়েদের নামে দেশে-বিদেশে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অবৈধভাবে অর্জন করেছেন।
পরে এ বিষয়ে আদেশ দেন আদালত। আদেশে বিচারক বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার আবেদন ও অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় আরজি মঞ্জুরযোগ্য মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। বর্ণিত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক (জব্দ) ও অস্থাবর সম্পত্তি ফ্রিজ (অবরুদ্ধ) করা না হলে তা হস্তান্তর হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না।
গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১’। এই পর্বে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জে বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ৬০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত চোখ-ধাঁধানো রিসোর্ট। তার পাশে কিনেছেন আরো ৮০০ বিঘা জমি। শুধু তা-ই নয়, রাজধানীর গুলশানে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটসহ দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি। হিসাব করে দেখা যায়, ৩৪ বছর সাত মাসের চাকরিজীবনে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ আয় করেছেন এক কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ২০০ টাকা। ফলে তাঁর এই বিপুল সম্পদের বৈধ উৎস নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
এ ছাড়া গত ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’। এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়। এতে বনের জমিই রয়েছে অন্তত ২০ বিঘা। ওই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে।
কালের কণ্ঠ’র এসব প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। পরে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। একই দিন বেনজীরের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন করেন সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে গত ২২ এপ্রিল তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির সদস্যরা হলেন কমিশনের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও নিয়ামুল হাসান গাজী। ২৩ এপ্রিল হাইকোর্টের এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয়।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) ১১৯টি দলিলের স্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ হয়েছে। এই স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে আছে গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএস (জি) ব্লকে ১৩৪ (পুরনো ১৩০) নম্বর রাস্তার ১ নম্বর প্লটে মোট ১৯ কাঠা ১২ ছটাক জমির ওপর নির্মিত র্যাংকন আইকন টাওয়ারে চারটি ফ্ল্যাট। বাকি ১১৫টি দলিলের সম্পত্তির মধ্যে আছে সাভারের মৈস্তাপাড়া মৌজার তিন কাঠা জমি। এই জমির মালিক বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জা। আর মাদারীপুরের রাজৈরে সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায় ১১৩টি দলিলসহ মোট ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহ পরিদপ্তরে নিবন্ধিত সাভানা ন্যাচারাল পার্ক প্রাইভেট লিমিটেড, সাভানা অ্যাগ্রো লিমিটেড, সাভানা ইকো রিসোর্ট ও একটি শিশির বিন্দু লিমিটেড। এই চারটি প্রতিষ্ঠানেরই শতভাগ মালিক বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এর বাইরে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আরো ১৫টি কম্পানির শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বলেন, ‘অনুসন্ধান চলাকালে বেনজীর আহমেদ কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আরো সম্পত্তির তথ্য এলে সেগুলোর কী করা হবে, সে বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/05/27/1391745