গত দেড় দশকে দেশে বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ফল অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটালেও বিদেশ থেকে নানাবিধ ফল আমদানির প্রবণতাও প্রবল। চলতি জ্যৈষ্ঠের মধুমাসে রসালো ফলে জমজমাট গ্রাম-গঞ্জ-শহর-জনপদ। এই সময়ের ফলের মধ্যে আম, লিচু, কাঁঠাল, আনারস, জাম, জামরুল প্রভৃতি অন্যতম। বাণিজ্যিকভাবে আম, লিচু, পেয়ারা, জাম, তরমুজ, লটকন, আনারস, বেল, কমলা, কলাসহ প্রায় সব ধরনের দেশী ফল ব্যাপক হারে উৎপাদিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিদেশী ফল উৎপাদনও শুরু হয়েছে। এই তালিকায় আছে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, মাল্টা, রাম্বুটান, রকমেলন ইত্যাদি। ড্রাগনসহ বাহারি সব বিদেশী ফল এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশে মাল্টা ও কমলার উৎপাদনও লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। কাজুবাদাম ও কফির আবাদ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দেশীয় ফলের মধ্যে আম ও কাঁঠাল এখন সারাবছরই উৎপাদন হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশী-বিদেশী জাত মিলে ৭ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত ফলের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার টন। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ হেক্টর জমিতে দেশে ফলের উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ২১ লাখ ৫২ মেট্টিক টন। এছাড়া ২০১৭-১৮ সালে ৭ লাখ ২৪ হাজার ২৮ হেক্টর জমিতে ১ কোটি ২১ হাজার ১৩ মেট্টিক টন, ২০১৬-১৭ সালে ৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৪১ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত হয় ১ কোটি ২০ লাখ ৯৬ মেট্টিক টন ফল। সরকারি সংস্থা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পেয়ারা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৩ টন, কলা ২৯ লাখ ৭৮ হাজার ৭২৩ টন, পেঁপে ৭ লাখ ১৩ হাজার ৯৪৩ টন ও কুল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৫৭ টন উৎপাদিত হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশী ফলের উৎপাদন ও বাজার দুটিই বেড়েছে। ফলে কৃষকেরা দেশী-বিদেশী উভয় ফলের চাষে ঝুঁকছেন।
আমদানিও বাড়ছে: দেশী ফলের চাষের পাশাপাশি বেড়েছে বিদেশী ফল আমদানিও। ডলার-সংকটের কারণে গত বছরের মে মাসে ফল আমদানির ওপর বাড়তি নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো হয়, তা সত্ত্বেও ফল আমদানি কমেনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের মে থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ফল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ; অর্থাৎ প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কমলা ও আপেল আমদানি হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪ লাখ ১৯ হাজার টন ফল আমদানি হয়েছে। তবে একজন কৃষি কর্মকর্তার দাবি, প্রতিবছর দেশে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। ফল আমদানির পরিমাণ এখন দিনে দিনে কমছে। দেশেই এখন নতুন নতুন বিদেশী ফল উৎপাদন হচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে, দেশের টাকা দেশেই থাকবে।
ফল খাওয়া দ্বিগুণ বেড়েছে: কৃষি ও খাদ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তথ্য বলছে, মাত্র এক দশক আগেও দেশে জনপ্রতি ফলগ্রহণের পরিমাণ ছিল গড়ে মাত্র ৩৫ গ্রাম। ২০২২ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ গ্রামে। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে দেড় দশক ধরে চলা বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প। ফলের উৎপাদন বাড়াতে এর বাইরে ভূমিকা রাখছে আরো কয়েকটি প্রকল্প। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, গত এক যুগ আগে একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে যতো গ্রাম ফল খেতো, এখন তা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২ সাল শেষে দেশের একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৫ দশমিক ৪ গ্রাম ফল খায়। পুষ্টি প্রকল্পের একজন কর্মকর্তার মতে, দেশে এখন সারাছরই আম ও কাঁঠাল পাওয়া যায়। কাটিমন আম বারো মাসই উপাদন হয়। বারি-৬ জাতের কাঁঠালও বারোমাসি। মৌসুমের বাইরেও দেশীয় ফল যেনো সারাবছর পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে তারা বারোমাসি ফলের জাতগুলোকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।