এক দশক ধরে ফ্রিল্যান্সিংয়ে ঝোঁক বেড়েছে বাংলাদেশীদের। বর্তমানে দেশের ১০ লাখেরও বেশি তরুণ-যুবক অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে তাদের বার্ষিক আয় ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশীদের এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই।
বৈশ্বিক বিভিন্ন জরিপের তথ্য বলছে, ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যার হিসাবে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে এ খাতে বাংলাদেশের দক্ষ জনবলের সঙ্কট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর নিত্যনতুন কাজে দক্ষতা অর্জন করতে না পারায় পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা। জাগো নিউজ।
সম্প্রতি সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফ্রিল্যান্সিং খাতে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, ফ্রিল্যান্সার নিয়োগে বিশ্বে শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৯তম। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ৪৬ দশমিক ৯২। তালিকায় ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। এমনকি ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের অবস্থানও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ফ্রিল্যান্সিং খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ফ্রিল্যান্সার বাড়লেও দক্ষ কাজের লোক এখনো খুবই কম। ফ্রিল্যান্সাররা এত দিন যে কাজগুলো করে আয় করেছেন, তা এখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে অনায়াসেই করানো সম্ভব। পাশাপাশি নতুন করে মেধাবীদের এ খাতে আনা সম্ভব হচ্ছে না। যারা আসছেন, তাদেরও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরি করতে পারছে না বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কোন অবস্থানে?
বিগত কয়েক বছর ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধা দিতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক ঋণ ও পেমেন্ট পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে। এমনকি ফ্রিল্যান্সারদের সিআইপি মর্যাদা দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া তাদের নিবন্ধন কার্ড দিচ্ছে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
২০১৯ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ জানায়, দেশে রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ ৫০ হাজার। তাদের মধ্যে পাঁচ লাখ সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। ২০২৩ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনেও একই তথ্য জানিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
তবে ফ্রিল্যান্সারদের উন্নয়ন ও সহযোগিতায় কাজ করা বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) নেতারা বলছেন, দেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে তারা কাজ করছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত বাংলাদেশীদের ৫৫ শতাংশের বয়সই ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
এ দিকে ২০১৯ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারনেট সোসাইটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ২৪ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার ভারতের, যা সবচেয়ে বেশি। এরপরই ১৬ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। এরপর থেকে সরকার ও খাত সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে বলে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছেন।
বিএফডিএস নেতারা জানান, অক্সফোর্ডের প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল সংখ্যার হিসাব ধরে। আর সিইও ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে যে স্কোর দেয়া হয়েছে, তা মূলত কাজের দক্ষতাকে ভিত্তি করে। অর্থাৎ, সংখ্যার হিসাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে থাকলেও দক্ষ কর্মীর হিসাবে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
দক্ষ জনবল সঙ্কট কেন?
ফ্রিল্যান্সিংয়ে তরুণদের টানতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে এখন অনেক কাজ হচ্ছে। সারা দেশে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। এতে লাখো তরুণ-যুবক অংশ নিচ্ছেন। তবে এ প্রশিক্ষণ দক্ষ ফ্রিল্যান্সার তৈরিতে কতটা সহায়ক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
পাবনার ঈশ্বরদীতে গত বছরের ডিসেম্বরে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে সাত দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নেন স্নাতকে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী জুলফিকার রুবেল। সেখান থেকে প্রশিক্ষণের পর এখনো সেভাবে কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি। জানতে চাইলে জুলফিকার বলেন, ‘প্রশিক্ষণে শুধু ফ্রিল্যান্সিং কী, এ থেকে কিভাবে টাকা উপার্জন করা যায়- এসব বিষয় শেখানো হয়েছিল। কিন্তু কাজ কিভাবে করব তা শিখতে ও বুঝতে পারিনি। পরে ইউটিউব দেখে কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। মনোযোগ ধরে রাখতে না পারায় এখন কাজ বাদ দিয়েছি।’
এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষকদের দক্ষতা ও জানাবোঝার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেন বিএফডিএস সভাপতি তানজিবা রহমান। তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তাতে ফ্রিল্যান্সার তৈরি হয় না। সেখানে শুধু একটা ধারণা দেয়া হয় মাত্র। যারা প্রশিক্ষণ দেন, তারাও ফ্রিল্যান্স সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝেন না বলে আমি মনে করি।’ ‘বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের চাহিদা এক-দেড় বছর ধরে ক্রমাগত কমছে। এর কিছু কারণও রয়েছে। আমরা এত দিন অনেকগুলো কাজ করতাম, যেগুলো এখন এআই দখল করেছে। এআইয়ের পেছনের যে কাজগুলো, সেগুলো দেশের ফ্রিল্যান্সাররা সেভাবে শেখেননি।’
তানজিবা রহমানের কথায়, ‘যে সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারের কথা সরকার বলছে, তাদের নিউ টেকনোলজির সাথে পরিচয় করানো যায়নি। আপ স্কিলের কোনো প্রশিক্ষণও হয়নি, যেটা নতুন টেকনোলজির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ দিকগুলো নিয়ে কাজ না করলে অদূর ভবিষ্যতে এ খাতে বাংলাদেশের অবস্থান আরো তলানিতে নামবে।’
সম্ভাবনাময় এ খাত নিয়ে একই মন্তব্য করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর। তিনি দীর্ঘ দিন এ খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন। ফাহিম মাশরুরের ভাষ্য, ‘যারা ফ্রিল্যান্সিং করছেন তাদের অধিকাংশই খুবই প্রাথমিক স্তরের কাজ করে কিছু অর্থ উপার্জন করছেন। তাদের আগ্রহ থাকলেও ভালো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। সরকারি প্রশিক্ষণের তো কোনো ইমপ্যাক্টই নেই। এখানে ভালো প্রোগ্রামারদের আনতে হবে, তাদের দিয়ে প্রশিক্ষণ সেশন চালাতে হবে। এখনই এ উদ্যোগ নেয়া জরুরি। তা না হলে বাংলাদেশ ক্রমেই আরো পিছিয়ে পড়বে।’
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসছেন না মেধাবীরা
ফ্রিল্যান্সিংয়ে রাতারাতি অনেক আয়, এমন চটুল কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও এখনো সেভাবে এ খাতে মেধাবীদের অংশগ্রহণ নেই বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। স্বল্পশিক্ষিত এবং চাকরি না পাওয়া অনেকের শেষ ভরসাস্থল হিসেবেই এখনো পরিচিত ফ্রিল্যান্সিং খাত। মেধাবীদের ফ্রিল্যান্সিংয়ে না পাওয়া নিয়ে ‘হতাশ’ বিএফডিএসের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যতই ইতিবাচক কথাবার্তা হোক, এখনো দেশের মেধাবী তরুণরা এ কাজে খুব কম আসছেন। যারা অ্যাকাডেমিক দিক দিয়ে ভালো, এক্সট্রা কারিকুলামেও ভালো, তাদের আমরা পাচ্ছি না। অনেকে সব দিকে চেষ্টার পর কিছুই করতে না পেরে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসছেন। আমি তাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। তবে এটিই বাস্তবতা।’
এ বিষয়ে বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘সারা দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি যত বিশ্ববিদ্যালয়, সেখান থেকে বছরে অন্তত ২৫ হাজার কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েট করা তরুণ বের হচ্ছেন। তারা কোথায় যাচ্ছেন? সরকার বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কেন কাজে লাগাতে পারছেন না? আমি মনে করি, তাদের কাজে লাগাতে হবে। সরকার যদি সত্যিই ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ দিতে চায়, তাহলে এসব উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটকে দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ানো উচিত। তাহলে এ খাতে মেধাবীদের উপস্থিতি বাড়বে।’
সততা-নৈতিকতাও প্রশ্নবিদ্ধ
সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি ই-মেইল পায় বিএফডিএস। একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ১২ হাজার ডলার নিয়েও কাজটি করেননি। এ কারণে ওই প্রতিষ্ঠান দূতাবাসের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সারদের এ সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করে।
বিএফডিএস সভাপতি তানজিবা রহমান এ ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের ব্র্যান্ডিং এসব কারণে নিম্নমুখী হচ্ছে। অনেকে অগ্রিম কিছু পেমেন্ট পেয়ে কাজটা না করে সরে পড়েন। এতে সর্বোপরি বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের ক্ষেত্রে নেগেটিভ রিভিউ আসে। তানজিবা রহমান বলেন, একজন তরুণ ১২ হাজার ডলারের কাজ পেলেন। তার মানে ভবিষ্যতে তিনি এক লাখ ডলারের কাজও পেতে পারেন। সেদিকে নজর দিয়ে সততা ও নৈতিকতার সাথে কাজ না করে বরং তিনি পেমেন্ট নিয়ে সরে পড়লেন। কাজটিও করলেন না। ওই তরুণের এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের অন্য ফ্রিল্যান্সারদের জন্যও চরম নেতিবাচক বার্তা দিলো। এ কারণেই এ খাতে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে।’
ইন্টারনেটের নিম্নগতি ও বিভ্রাট
ইন্টারনেটের নিম্নগতি ও ঘন ঘন বিভ্রাটও বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটায়। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘ডিজিটাল প্রোগ্রেস অ্যান্ড ট্রেন্ডস রিপোর্ট-২০২৩’ অনুযায়ী, মাসে অন্তত সাতবার বাংলাদেশী গ্রাহকরা ইন্টারনেট বিভ্রাটের শঙ্কায় থাকেন। এতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়েন। বেশি দুর্ভোগে পড়েন ফ্রিল্যান্সাররা।
একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন আনিসুর রহমান। তিনি নিজেও কনটেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেন। বাসায় ওয়াইফাই সংযোগ থাকলেও লোডশেডিং এবং নিম্নগতির ইন্টারনেটের কারণে প্রায়ই বিপাকে পড়েন তিনি। আনিসুর রহমান বলেন, পলাডশেডিংয়ের সময় ওয়াইফাই পাওয়া যায় না। তখন মোবাইল ডাটা ব্যবহার করি। কিছুটা কম দামে প্যাকেজ পাওয়ায় টেলিটকের বর্ণমালা সিমে একটি প্যাকেজ কিনেছিলাম। সেই ডাটা দিয়ে কিছুই করা যায় না। কোনো ওয়েবসাইট ব্রাউজ করাও যায় না। ঢাকাতেই ইন্টারনেটের গতি এমন হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা নিশ্চয়ই আরো নাজুক।’
তবে ইন্টারনেটের নিম্নগতি এখন বড় ইস্যু নয় বলে মনে করেন বিএফডিএসের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে ইন্টারনেটের নিম্নগতি বলেন, আর লজিস্টিকস সাপোর্ট না পাওয়ার বিষয়টি বলেন, এগুলো কোনো বাধা নয়। বড় বাধা হলো প্রশিক্ষণ ও দক্ষ কর্মী না থাকা।’