দেশের পুঁজিবাজারের পতনের গভীরতা বাড়ছে। পতনের এই স্রোতকে ঠেকানো যাচ্ছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থার যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ পতনের স্রোতের ধারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে গত এক সপ্তাহে দেশের পুঁজিবাজার থেকে ৬৪ হাজার ১৬৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা বের হয়ে গেছে। ডিএসইতে ১৯ খাতের বিনিয়োগকারীরা লোকসানে রয়েছেন। চরম বিক্রির চাপে রেখেছেন প্রভাবশালী এক শ্রেণীর বিনিয়োগকারী। ফলে ক্রেতার সঙ্কট বা বাজারে স্বাভাবিক লেনদেনের কোনো ক্রেতা নেই। বিক্রির চাপে ছিল ব্যাংকিং খাত, প্রকৌশল খাত, টেলিকম খাত, খাদ্য খাতের কোম্পানির শেয়ারগুলো। বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাবশালী বিক্রির চাপের দ্বারা পতন টেনেছে। দুই সপ্তাহ ধরে টানা পতনের স্রোতে নিম্নমুখিতায় পুঁজিবাজার। বিক্রির চাপ ছিল ৮৫ শতাংশ, যেখানে ক্রেতা মাত্র ১৫ শতাংশ। মূলধনী লাভের ওপর কর আরোপের সংবাদ থাকায় বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।
সাপ্তাহিক পুঁজিবাজার নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্লেষক রয়েল ক্যাপিটালের পর্যবেক্ষণের তথ্য বলছে, পুঁজিবাজারে সূচক দুই সপ্তাহ ধরে নিম্নমুখী থাকার পাশাপাশি সব খাতে শেয়ার দর কমেছে। বিনিয়োগকারীরা অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শঙ্কিত ছিলেন। এছাড়া মূলধনী লাভের ওপর কর আরোপের সংবাদ থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে সতর্ক অবস্থানে। পুরো সপ্তাহে গড় টার্নওভার ৩২.২৯ শতাংশ কমেছে। সপ্তাহজুড়ে ৪৫টি শেয়ারের বাজার দর বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩১০টি শেয়ারের বাজার দর পতন ঘটেছে। বাজার মূল্যের ভিত্তিতে সব সেক্টরে এই সপ্তাহে মূল্যপতন হয়েছে। তবে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলা যায়, আগামী সপ্তাহে বাজারের সূচক কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পাশাপাশি মাঝারি পরিমাণে লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডিএসইর লেনদেনের তথ্য থেকে জানা গেছে, পুরোটা সপ্তাহজুড়ে দেশের পুঁজিবাজার ছিল টালমাটাল। দরপতনের স্রোতে ১৯ খাতের মধ্যে ডিএসইতে সবচেয়ে বেশি দর কমেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এ খাতে বিদায়ী সপ্তাহে দর কমেছে ৫২.৭২ শতাংশ। ৮.৪৬ শতাংশ দর কমেছে সেবা ও আবাসন খাতে। একই সময়ে ৮.৩৪ শতাংশ দর কমেছে আর্থিক খাতের। তালিকায় থাকা অন্য খাতগুলোর মধ্যে- সিরামিক খাতে ৭.৩৮ শতাংশ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৭.২০ শতাংশ, লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতে ৭.০৫ শতাংশ, কাগজ ও প্রকাশনা খাতে ৬.৯১ শতাংশ, প্রকৌশল খাতে ৬.১৭ শতাংশ, ভ্রমণ ও অবকাশ খাতে ৫.৮৬ শতাংশ, জেনারেল ইন্স্যুরেন্স খাতে ৫.৮২ শতাংশ, চামড়া খাতে ৫.৭৬ শতাংশ, সিমেন্ট খাতে ৫.৫৩ শতাংশ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে ৪.৪৯ শতাংশ, বস্ত্র খাতে ৫.১০ শতাংশ, ওষুধ ও রসায়ন খাতে ৩.৯৩ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে ২.২১ শতাংশ, ব্যাংক খাতে ২.০৯ শতাংশ, বিবিধ খাতে ২.০৮ শতাংশ এবং করপোরেট বন্ড খাতে ১.৩৬ শতাংশ দর কমেছে। বেশি দর বেড়েছে টেলিকমিউনিকেশন খাতে। এই খাতে দর বেড়েছে ০.৩১ শতাংশ এবং ০.১৪ শতাংশ দর বেড়েছে পাট খাতে।
গেলো সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন হয়েছে ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর আগের সপ্তাহে ছিল ৭ লাখ এক হাজার ৮২৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার থেকে মূলধন চলে গেছে ৪৮ হাজার ৭৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। সপ্তাহে টাকার অঙ্কে মোট লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর আগের সপ্তাহে যা ছিল ৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪১ লাখ টাকা। লেনদেন কমেছে ১ হাজার ৭৫১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। পাশাপাশি গড় লেনদেন হয়েছে ৫১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর আগের সপ্তাহে যা ছিল ৭৬৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। গড়ে লেনদেন কমেছে ৩২ শতাংশ।
ডিএসইতে মোট ৪১১টি কোম্পানি লেনদেনে অংশগ্রহণ করেছিল। যার মধ্যে দর বেড়েছে ২৮টির, অপরিবর্তিত ছিল ২০টির এবং কমেছে ৩৩৮টি কোম্পানির। আর ২৫টি কোম্পানির কোনো লেনদেন হয়নি। ডিএসই প্রধান সূচক-ডিএসইএক্স সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে ২০৫.০২ পয়েন্ট। ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৬৬.২৯ পয়েন্ট, শরিয়াহ্ সূচক-ডিএসইএস কমেছে ৫২.৬২ পয়েন্ট এবং ডিএসএমইএক্স কমেছে ৩৬.৭১ পয়েন্ট।
আর চট্টগ্রাম স্টকে অর্থাৎ সিএসইতে সদ্য বিদায়ী সপ্তাহে বাজার মূলধন কমেছে ১৫ হাজার ৪০৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। পুরো সপ্তাহে ৩ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ৯২৫টি শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ড হাতবদল হয়েছে ১৫৫ কোটি ৮ লাখ ২৬ হাজার ৪৩৯ টাকা বাজারমূল্যে। আগের সপ্তাহে হয়েছিল ২১৩ কোটি ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৭ টাকার। সপ্তাহের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ৫৮ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার ৩৩৮ টাকা। সিএসইতে মোট ৩০৫টি কোম্পানি লেনদেনে অংশগ্রহণ করেছিল। যার মধ্যে দর বেড়েছে ৩৯টির, কমেছে ২৫২টির এবং অপরিবর্তিত ছিল ১৪টি কোম্পানির। সিএসই প্রধান সূচক-সিএএসপিআই কমেছে ৬০৩.১৬ পয়েন্ট, সিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৪১২.৭৩ পয়েন্ট, সিএসসিএক্স কমেছে ৩৭২.৮৩ পয়েন্ট। বাজার মূলধনে এ শ্রেণীর শেয়ারের প্রাধান্য ছিল ৭১.২৯ শতাংশ, বি শ্রেণীর ২৬.৪৯ শতাংশ, এন শ্রেণীর ১.৮৪ শতাংশ এবং জেড শ্রেণীর ছিল ০.৩৬ শতাংশ।
বাজার পর্যালোচনায় ইস্টার্ন ব্যাংক সিকিউরিটিজ বলছে, পুঁজিবাজারের প্রধান সূচকটি তার মুক্তপতনকে গভীর করতে আরও নিমজ্জিত হয়েছে। প্রভাবশালীরা বিক্রির চাপের দ্বারা পতন টেনেছে। কারণ বাজারের গতিবেগ সম্পর্কিত দীর্ঘায়িত হতাশাগ্রস্ত অনুভূতির মধ্যে আরও ক্ষতি এড়াতে উদ্বেগহীন বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজিবাজারের এক্সপোজার কমাতে কমানোর পথ বেছে। আইসিবি সিকিউরিটিজের জন্য নন-মার্জিন সীমা সুবিধা বাড়ানোর নিয়ন্ত্রক উদ্যোগ সত্ত্বেও, স্থায়ী হতাশা প্রশমিত হতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জাতীয় বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে সপ্তাহজুড়ে বিক্রেতাদের আধিপত্য ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ডিএসইএক্স ২০৫ পয়েন্ট হারিয়ে ৫ হাজার ৩১২ পয়েন্টে স্থির হয়। বিনিয়োগকারীরা বেশির ভাগই ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে (২৪.৬ শতাংশ), খাদ্য খাতে (১২.৬ শতাংশ) এবং বস্ত্র খাতে (১১.৩ শতাংশ) সক্রিয় ছিল।