উৎপাদন এলাকাখ্যাত বগুড়া অঞ্চলে হিমাগার পর্যায়েই আলুর দাম আড়াই মাসে আড়াই গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি সাদা ও লাল জাতের আলু গড়ে ২০ টাকা এবং দেশি ছোট জাতের আলু ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার হিমাগার ফটকে পাইকারিতে প্রতি কেজি সাদা ও লাল আলু বিক্রি হয়েছে ৪১ থেকে ৪২ টাকায়। আর দেশি আলুর দাম উঠেছে ৫১ টাকা কেজিতে।
পাইকারি কয়েক গুণ মূল্যবৃদ্ধির পর খুচরায় এসে আরেক দফায় বাড়ছে আলুর দাম। বগুড়া শহরে বৃহস্পতিবার খুচরায় দেশি ছোট আলুর দাম ছিল ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি। সাদা ও লাল আলুর কেজি ছিল ৫০ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তদারকির অভাবে কম দামে কেনা আলু হিমাগারে সংরক্ষণের পর মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত বছর হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে তিন গুণ মুনাফা হওয়ায় পুরোনো মজুতদারের সঙ্গে এবার নতুন মজুতদারও যুক্ত হয়েছেন। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে লাখ লাখ বস্তা আলু কিনে হিমাগারে সংরক্ষণের পর কয়েক মাসের ব্যবধানে কয়েক গুণ বেশি দামে এখন বিক্রি করছেন মজুতদারেরা।
এদিকে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায় হিমাগারমালিকেরা গুদাম ভাড়া ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত মৌসুমে ৬০ কেজি ওজনের ১ বস্তা আলু হিমাগারে রাখতে ভাড়া ছিল ২৮০ টাকা। এ মৌসুমে সেই ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৫০ টাকা।
বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় এবার প্রায় ৯৪ হাজার হেক্টর জমিতে ২০ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। সংরক্ষণ জটিলতা ও খরচ তুলতে কৃষকেরা বেশির ভাগ আলু মাঠ থেকেই বিক্রি করে দেন। বর্তমানে ২ জেলার ৬১টি হিমাগারে সংরক্ষিত আছে ৫ লাখ ২০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আলু। ব্যবসায়ী ও মজুতদারেরা এসব আলু সংরক্ষণ করেছেন। হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে সাত থেকে আট টাকা খরচ হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার দুই জেলার হিমাগার পর্যায়ে রেকর্ড পরিমাণ আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন হিমাগার থেকে আলু বিক্রিও বেড়ে গেছে। হিমাগারমালিকেরা বলছেন, এরই মধ্যে ২ জেলার ৬১টি হিমাগারে সংরক্ষিত ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আলু বিক্রি হয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই জেলায় এবার ৫৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৬১৬ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে জেলার ৪২টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন আলু। এসব হিমাগারের মোট ধারণক্ষমতা ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬২০ টন। আর জয়পুরহাটে ৩৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে ৮ লাখ ২৩ হাজার ১৩ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে এই জেলার ১৯টি হিমাগারে ১ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সাদুরিয়া এলাকার ১০টি হিমাগারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) সাদা ও লাল আলু বর্তমানে ২ হাজার ৪৫০ টাকায় এবং দেশি ছোট আলু ৩ হাজার ১০০ টাকায় হিমাগার পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে। দুই জেলায় হিমাগার পর্যায়ে প্রতি বস্তা আলুর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা বেড়েছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার শাহ সুলতান হিমাগার-২–এর ব্যবস্থাপক আবুল হাশিম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হিমাগারে সংরক্ষিত প্রতি বস্তা সাদা জাতের আলু বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৪৪০ টাকা আর দেশি আলু বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার টাকায়। গত বছর এক বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩৫০ টাকা।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার পাল বলেন, সংরক্ষণ পর্যায়ে এ বছর সাদা জাতের এক বস্তা আলুর (৬০ কেজি) দাম ছিল গড়ে ২০ টাকা। তার সঙ্গে ৩৫০ টাকা হিমাগার ভাড়া এবং চটের বস্তা ও পরিবহন খরচ ১৩০ টাকাসহ এক কেজি আলু সংরক্ষণে খরচ পড়েছে ৮ টাকা। সেই হিসাবে ১ কেজি আলু হিমাগার থেকে বের হওয়া পর্যন্ত খরচ ২৮ টাকা। বৃহস্পতিবার সেই আলু বিক্রি হয়েছে ৪১ টাকা কেজি দরে।
বগুড়ার শিবগঞ্জের ধারিয়া গ্রামের আলুচাষি আওলাদ হোসেন বলেন, ‘খেত থেকে আলু তোলার পর বোরো চাষের প্রস্তুতি নিতে হয়। বোরোর চাষাবাদের খরচের জন্য মাঠ থেকেই ১৮ থেকে ২০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করেছি। সেই আলু এখন বাজার থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে। কৃষকেরা ভালো মুনাফা না পেলেও মজুতদার ও ব্যবসায়ীরা ভালো মুনাফা করছেন’
বগুড়া সদরের আগমনী কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক এ কে এম আবদুল্লাহ, শিবগঞ্জের নিউ কাফেলা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক নুরন্নবীসহ বেশ কয়েকজন হিমাগারমালিক জানান, গত মৌসুমে আলু সংরক্ষণ করে কয়েক গুণ মুনাফা হওয়ায় এবার অনেক নতুন ব্যবসায়ী হিমাগারে আলু সংরক্ষণে বিনিয়োগ করেছেন।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হিমাগারে আলুর দাম বাড়লেও তাতে কৃষকের কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ, উৎপাদন মৌসুমেই কৃষকেরা সিংহভাগ আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই এখন হঠাৎ আলুর বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। শুধু তদারকির অভাবেই আলুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ, জনপ্রতিনিধিসহ সবাই মিলে সম্মিলিত উদ্যোগ নিলে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
কৃষকেরা জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে খেত থেকে আলু তোলা শেষ হয়। মাঠ থেকেই বেশির ভাগ আলু মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে হিমাগারে মজুত করেন। এখন হিমাগার থেকে বেশি দামে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে।