গ্যাস সংকটের কারণে ২০১৯ সাল থেকে সারা দেশে নতুন করে আবাসিক গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ রয়েছে। এরপরও রাজধানী জুড়ে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অনেক নতুন ভবনেই লাইনের গ্যাসে রান্না হচ্ছে। কেউ আবার পুরাতন ভবনেই ১২টার অনুমতি নিয়ে চালাচ্ছেন ২২টা চুলা। অনেক বস্তিতে আবার বিল ছাড়াই রাতে-দিনে দেদারছে পুড়ছে চোরাই লাইনের গ্যাস। মোহম্মদপুর, মিরপুর. ধানমণ্ডি, রামপুরা, বনশ্রী, শ্যামলী, বনানী, আফতাবনগর, বাড্ডা, খিলখেত, কুড়িল বিশ্বরোডসহ রাজধানীর অনেক স্থানেই দেখা গেছে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। আর এসবই হচ্ছে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে। যা যোগ হচ্ছে সিস্টেম লসের খাতায়। এতে বছরে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
সরজমিন রাজধানীর মোহম্মদপুর ঢাকা উদ্যান এলাকায় দেখা যায়, এলাকার অনেক নতুন ভবনেই বিপজ্জনকভাবে রাইজার বসিয়ে নেয়া হয়েছে লাইন গ্যাসের সংযোগ। ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে নিয়মিত নেয়া হচ্ছে গ্যাসের বিল। কোনো ভবনে আবার আগের পুরাতন একটি লাইনের অনুমতি থাকলেও গোপনে আরও একাধিক সংযোগ নিয়েছেন ভবন মালিকরা।
রফিকুল ইসলাম নামে এলাকাটির এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, এলাকাটির অধিকাংশ বাসিন্দাই অবৈধ গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করছে। এ কারণে বৈধ গ্যাস সংযোগকারীরা গ্যাস কম পাচ্ছেন। এরপরও রাতের আঁধারে একটি চক্র তিতাসের মূল সংযোগ থেকে নিম্নমানের পাইপ দিয়ে বিভিন্ন বাড়িওয়ালার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদান করে আসছে। আর এই কারণেই সকালে অভিযান চালিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে গেলেও বিকালে আবারো চালু হয়ে যায় গ্যাসের লাইন। এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, ’১৮ সালের শেষ দিকে আমি ছয়তলা বাড়ির নির্মাণকাজ শুরু করি। নির্মাণাধীন বাড়িটির জন্য তখন গ্যাস সংযোগ চেয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে আবেদন করি। কিন্তু গ্যাস সংযোগ পাননি।
গ্যাস সংযোগ না থাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে পারছিলাম না। কবে গ্যাস দেয়া হবে, তাও স্পষ্ট করে বলছে না তিতাস কর্তৃপক্ষ। তাই বাধ্য হয়ে অবৈধ সংযোগ নিয়েছিলাম। এদিকে পশ্চিম ধানমণ্ডির সুলতানগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা কামরান পারভেজ। তার একটি ছয়তলা পুরাতন ভবনের পাশেই বছর দুয়েক আগে আরেকটি আটতলা নতুন ভবন গড়ে তুলেছেন। সেখানে প্রায় বিশটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনিও তার পুরাতন ভবনের লাইন থেকে নতুন ভবনে গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার টাকা-পয়সা সব জমা দেয়া আছে। তিতাসের মিস্ত্রি এসেই এই লাইন দিয়ে গেছে। নতুন সংযোগ দেয়া শুরু হলে আমার নাম খাতায় উঠে যাবে। মেহেদী হাসান নামে এলাকাটির বাসিন্দা বলেন, তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এসব অবৈধ সংযোগ নেয়া সম্ভব নয়। একজন সাধারণ মানুষ কোনো ভাবেই পাইপলাইন ছিদ্র করে এমন সংযোগ নিতে পারবে না। তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীই মূল পাইপলাইনে ছিদ্র করে বিকল্প পাইপলাইনের মাধ্যমে অবৈধ সংযোগ দেয়। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায়ও দেদারছে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়ে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে বিল নেয়া হচ্ছে। এলাকাটির ৮তলা ভবনের ভাড়াটিয়ারা জানান, বাড়ির মালিককে বিল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লাইন গ্যাসেই রান্না করে আসছেন তারা। বিল্ডিংয়ে উঠার সময়ই বাড়িওয়ালা লাইনের গ্যাস আছে বলে তাদেরকে জানিয়ে দেয়। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বাড়ির মালিক পুলিশ কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিক দাবি করেন, তার বাড়িতে কোনো অবৈধ গ্যাসের সংযোগ নেই। বৈধ গ্যাস সংযোগ পেতে তার আবেদন প্রক্রিয়াধীন। ঠিক একইভাবে মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বাড্ডা, কল্যাণপুর, বাসাবো, মগবাজার, আজিমপুর, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, জুরাইন, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সংযোগে দেদারছে পুড়ছে লাইন গ্যাস।
অপরদিকে রাজধানীর বস্তিগুলোতেও হিসাব ছাড়াই ব্যবহার হচ্ছে লাইন গ্যাস। মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি, রূপনগরের ঝিলপাড়ের বস্তি, কালশীর দুয়ারীপাড়া বস্তি, গুলশানের কড়াইল, বৌবাজার ও জামাইবাজার, মহাখালীর সাততলা বস্তি, খিলগাঁও ঝিলপাড়, বাসাবোর ওহাব কলোনি, মগবাজারের মধুবাগ ঝিলপাড়, শান্তিবাগ রেললাইন, মালিবাগ, মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী, বৌবাজার, হাজারীবাগসহ প্রতিটি বস্তির নিচ দিয়ে গিয়েছে গ্যাসের সঞ্চালন লাইন। আর এই সঞ্চালন থেকে হোর্স পাইপের মাধ্যমে লাইন টেনে প্রতিটি ঘরে নেয়া হয়েছে গ্যাসের লাইন। তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দিষ্ট মাসোহারা দিয়ে এসব লাইন দিয়ে নিয়মিত টাকা তুলছে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসক্ষেত্র থেকে নিয়ে বিতরণ কোম্পানির কাছে গ্যাস সরবরাহ করা হয় সঞ্চালন লাইনে। এরপর বিতরণ লাইনের মাধ্যমে তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছায় ছয়টি বিতরণ কোম্পানি। অবৈধ সংযোগ দিয়ে গ্যাস চুরির অভিযোগ আছে এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে। এসব গ্যাস কারিগরি ক্ষতির (সিস্টেম লস) নামে অপচয় ধরে চালিয়ে দেয়া হয়। এ ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এখন এর কিছুটা ভাগ করে চাপানো হয়েছে সঞ্চালন লাইনে। গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে রাজধানী জুড়ে সবচেয়ে বেশি লাইন রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটির মোট বৈধ গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৭ জন। তিতাস গত দুই বছরে ৩৩৬টি শিল্প, ৪৭৫টি বাণিজ্যিক, ৯৭টি ক্যাপটিভ পাওয়ার, ১৩টি সিএনজি স্টেশন এবং ৯৮৯ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন অপসারণ করেছে। মোট ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭০টি গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। এ থেকেই ঠার করা যায় বৈধর তুলনায় তাদের অবৈধ সংযোগ কতো রয়েছে।
তিতাস সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস-সংকটের কারণে নিষেধ ২০১৯ সালের ২১শে মে এক আদেশে আবাসিক, সিএনজি ও বাণিজ্যিক স্থাপনায় নতুন গ্যাস সংযোগ না দিতে নির্দেশনা জারি করে সরকার। ওই সময়ের আগে যারা ডিমান্ড নোটের (অগ্রিম) টাকা জমা দিয়েছেন, সম্প্রতি তাদের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগ। তিতাস গ্যাসের মহাব্যবস্থাপক মো. রশিদুল আলম বলেন, আমরা অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিষয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে চলেছি। যেখানে খবর পাচ্ছি সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এটি চলতে থাকবে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেছেন, আমরা গ্যাসের সামগ্রিক সিস্টেম লস কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছি। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে চুরি, সেই চুরি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আবার তারা সংযোগ নিচ্ছে কিনা এক মাস পর আবার ফলোআপ করতে বলা হয়েছে। বিতরণ কোম্পানির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।