কেউ সৌদি আরব, কেউবা আরব আমিরাতের মতো দেশে চাকরি করছিলেন। কারো ছিল চালের আড়ত, কেউবা দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন। এর পরও আরেকটু সচ্ছল হতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
ভেবেছিলেন সমৃদ্ধ দেশ ইতালিতে পা দিলেই ঘুরে যাবে ভাগ্যের চাকা। কিন্তু সেই আশা ধূলিসাৎ ভিএফএসের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতিতে।
দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাংলাদেশি কর্মীদের ইতালি যাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ করে দেয় সংস্থাটি। ফলে এসব কর্মীর ভাগ্য বদলের চাকা থমকে গেছে।
তাঁরা এখন দিশাহারা। অনেকের তো সংসারে টিকে থাকার শেষ অবলম্বনও নেই। সীমাহীন মানসিক ও আর্থিক কষ্টে ভুগতে থাকা এসব মানুষের চাওয়া এখন একটাই—তা হলো ইতালির ভিসা।
দুর্ভোগে পড়া এসব মানুষের সংখ্যা লক্ষাধিক।
শুধু ইতালি দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা এক লাখ ১১ হাজার। সম্প্রতি এতে যোগ হয়েছেন আরো প্রায় ১০ হাজার মানুষ। তাঁদের পাসপোর্ট আটকে থাকলেও ইতালিতে চলে গেছে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা, যা তাঁরা জোগাড় করেছিলেন ধারদেনা করে কিংবা জীবনের শেষ সম্বল হাতছাড়া করে। ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন বোনা এক লাখ ২০ হাজার কর্মীর জীবনে এখন ঘোর অন্ধকার।
ইতালিতে কৃষি ও স্পন্সর ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাচ্ছেন।
ঢাকার ইতালি দূতাবাসের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছরের আগস্ট থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৬ মাসে এক লাখ ১১ হাজার কর্মীর পাসপোর্ট জমা রয়েছে দূতাবাসে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এর সঙ্গে যোগ হয় আরো ৯ হাজার ৬০০টি পাসপোর্ট। নিয়ম অনুযায়ী, তথ্যের সত্যতা যাচাই-বাছাই শেষে তিন মাসের মধ্যে ভিসার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশি কর্মীদের পাসপোর্ট আটকে রয়েছে ১৬ মাস বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে। উদ্ভূত সংকট নিরসনে আটকে থাকা পাসপোর্টগুলো দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সুরাহার আশ্বাস দিয়েছিলেন ইতালিয়ান রাষ্ট্রদূত আন্তেনিও আলেসান্দ্রো। তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে ইতালি যেতে ইচ্ছুক কর্মীরা এখন শুধু মানবেতর জীবন যাপন করছেন না, বাধ্য হয়ে কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো পেশা বেছে নিচ্ছেন।
তাঁদেরই একজন নওগাঁর মহাদেবপুরের ছেলে মোহাম্মদ অপু (৩৫)। বাবা কৃষিকাজ করেন। অপুর ঢাকায় চালের আড়তের ব্যবসা ছিল। পরিবার নিয়ে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ভালোই ছিলেন। ২০২২ সাল থেকে শুরু করেন ইতালি যাওয়ার চেষ্টা। গত বছরের ১৭ মে হাতে পান নুলস্তা (ইতালির ওয়ার্ক পারমিট)। এর জন্য শুরুতেই তিনি ইতালিতে পাঠিয়ে দেন সাড়ে ১৩ লাখ টাকা। ধারদেনা করে এই টাকা জোগাড় করেন। ভেবেছিলেন দ্রুত গিয়ে দেনা পরিশোধ করবেন। দালাল ধরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে পাসপোর্টও জমা দেন। তবে আট মাসেও হাতে পাননি পাসপোর্ট। নিরুপায় হয়ে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে নিজে হয়ে যান বাইকার। এখন প্রতিদিনই ভিএফএস কার্যালয়ে ঢুঁ মারেন—ভিসা হলো কি না।
গতকাল সোমবার মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে মো. অপু বলেন, ‘গত বছরের মে মাসে আমি নুলস্তার জন্য সাড়ে ১৩ লাখ টাকা দিয়েছি। নুলস্তা পাওয়ার পর আমার দালাল অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় দেয় আগস্টে। সে অনুযায়ী আশায় ছিলাম শিগগিরই ভিসা-পাসপোর্ট পাব। কিন্তু এখনো সেই অপেক্ষার মধ্যেই আছি। সপ্তাহে চার দিন গুলশান-১ নম্বরে ভিএফএস গ্লোবালের অফিসে যাই। কিন্তু কোনো কূলকিনারা নেই।’
ধরা গলায় অপু বলেন, ‘নিশ্চিন্তপুরে চালের দোকানটি বিক্রি করে দিয়েছি। নুলস্তা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে দালালের টাকাসহ আরো যাবতীয় খরচ মেটাতে আমার সব সম্বল শেষ। এর মধ্যে ঋণের বোঝা ভারীই হচ্ছে। উপায় না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি বাইক চালিয়ে কোনোমতে সংসারের হাল ধরে আছি।’
পিরোজপুরের বাসিন্দা মুক্তা হাওলাদারেরও কষ্টের শেষ নেই। ২০২৩ সালে আট লাখ টাকা দিয়ে স্বামী রতন বড়ালের জন্য ইতালির নুলস্তা সংগ্রহ করেন। সে সময় থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট জটিলতাসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর স্বামীকে চাকরি হারাতে হয়। মুক্তা হাওলাদার ও রতন বড়াল ভেবেছিলেন, তাঁদের এই সমস্যাটি হয়তো বেশি দিন থাকবে না। কিন্তু ভিএফএসে পাসপোর্ট জিম্মি হয়ে দীর্ঘ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। একদিকে সংসারের খরচ, আরেক দিকে নুলস্তার জন্য ঋণের বোঝা, সব মিলিয়ে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা।
গতকাল মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে মুক্তা হাওলাদার বলেন, ‘২০২৩ সালের ১৭ মে নুলন্তা পাই। এটি বাবদ আমাদের আট লাখ টাকা দিতে হয়েছে। এরপর নানা জটিলতায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছিলাম না। গত বছরের আগস্টে চট্টগ্রামে পাসপোর্ট জমা দিই। এখনো পাসপোর্ট ফেরত পাইনি।’
মুক্তা বলেন, ‘আমার স্বামী একটা বেসরকারি চাকরি করতেন। এই ওয়ার্ক পারমিট পাওয়ার পরে যে জটিলতা, আমাদের সংশয়, দৌড়াদৌড়ি সব কিছুর কারণে তাঁর চাকরিটাও চলে যায়। এরপর থেকে তিনি আর কোনো কাজে যোগ দিতে পারেননি। ঢাকায় থেকে এক বছর ধরে ধার করে নানাভাবে চলছেন। এ ছাড়া যেই টাকা আমরা ধার করে নুলস্তা এনেছি, সেই টাকা বাবদ মাসে ১৬ হাজার টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। আমাদের অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। আমি একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করে কোনোমতে সংসারের হাল ধরে রেখেছি।’
দালালকে টাকা দিয়েও প্রতারণার শিকার
দালালকে টাকা দিয়েও অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন। তাঁদের একজন ইতালি বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ম্যানেজার শাহ মাশফিকুর রহমান মুকুল। প্রথমবার ৫০ হাজার টাকা দিয়েও ভিসা মেলেনি। পরেরবার আবার ৪৫ হাজার টাকা খরচ করেও মেলেনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ভিএফএস গ্লোবালের সামনে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে তাঁর কথা হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি আমার এক ভাইয়ের জন্য ৫০ হাজার টাকা খরচ করে স্লট নিয়েছি। তারপর গত মাসের ২৩ তারিখ চট্টগ্রামে পাসপোর্ট জমা দিই। এর কিছুদিন পর ২ মে আমাদের পাসপোর্ট কালেক্ট করতে বলা হয়। তখন পাসপোর্ট কালেক্ট করে দেখি তার অনুমোদনের মেয়াদ ৯০ দিনের কম রয়েছে। সে জন্য ভিসা মেলেনি। এরপর আবার আমি সাতক্ষীরার বাসিন্দা রাকে মজুমদার নামের একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে আমার কাছে প্রতি অনুমোদনে ২০ হাজার করে টাকা চেয়েছে। আমি তাকে অগ্রিম ২৫ হাজার টাকা দিয়েছি। সে আজ (১২ মে) আরো ২০ হাজার টাকা চেয়েছে। বলেছে, চারটা ফাইলের জন্য প্রথমে তাকে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া লাগবে। সে আমাকে ১৪ মের মধ্যে এটার একটা নিশ্চয়তা দেবে, আমি স্লটটা কবে পাব। আমি ১৪ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষায় আছি। সে যদি কাজটা করতে পারে, তাহলে বুঝব ভিএফএস গ্লোবালের ভেতরে কোনো সিন্ডিকেট আছে, যারা টাকার বিনিময়ে কাজ করতে পারবে।’
১৪ তারিখে মুকুলের সঙ্গে আবার কালের কণ্ঠ’র কথা হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘দালাল আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে। এখন সে বলছে টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু অ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঠানোর পর থেকে দালালকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমরা কী করব বলেন? ভিএফএসে গেলে কোনো উত্তর পাই না। এদিকে সঠিক দালালও পাই না। ভিএফএসের কারণেই আমরা এই ভোগান্তির শিকার হচ্ছি।’
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে উঠে আসা সর্বশেষ দালাল রাব্বির সঙ্গে মিলে যায় এই ঘটনা। রাব্বি বলেন, তাঁর এই জায়গা ছাড়া আর কেউই কোনো কাজ করতে পারবে না। তাঁরাই মূল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। এই সিন্ডিকেটে রাকে মজুমদার নামের কেউ আছে কি না জানতে চাইলে রাব্বি বলেন, ‘তিনি তাকে চেনেন না।’
দ্রুত আইনি ব্যবস্থা প্রয়োজন
এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সাধারণ মানুষকে হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভিএফএসের মতো সংস্থাকে সম্প্রতি যে ভিসা প্রক্রিয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্ব হলো ইউরোপের দেশগুলোতে যাওয়া মানুষগুলো যেন প্রতারণা বা হয়রানির শিকার না হয়। যেকোনো দেশের দূতাবাস বা সরকার তাদের ব্যয় সংকটে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দিয়ে থাকে। এর ফলে ভিসাপ্রক্রিয়ার বিষয়টি মানুষের কাছে সহজতর হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো ঘটনা। এই বিষয়গুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। সেই জায়গাটাকে যারা ম্যানুপুলেট করে পুরো সিস্টেমটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে, তারা তো আসলে অধিকতর অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে। সেটার জন্য তাদের জবাবদিহিতে আনা অপরিহার্য।’
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক যে দুর্নীতি, সেই দুর্নীতির তুলনায় এখানে অ্যাডভান্স লেভেলের দুর্নীতি হচ্ছে। বিষয়টি যদি সঠিক প্রমাণিত হয় তাহলে তারা ডিজিটাইজেশন করে সেটাকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। তারা যাতে এ ধরনের প্রতারণা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে নেয়। এর পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ বিষয়টিকে খতিয়ে দেখতে হবে।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/05/21/1389869