সাম্প্রতিক সময়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক নিয়ে দুটো প্রতিবেদন চোখে পড়লো। একাধিক নিউজপোর্টালে প্রতিবেদনগুলো প্রচারিত হয়েছে। এই ব্যাংকের বেশ কিছু শাখার গ্রাহকেরা নিজের একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারছেন না। দিনের পর দিন ব্যাংকে যাচ্ছেন, কিন্তু এক বা দেড় লাখ টাকা দেওয়ার মতো অবস্থাতেও ব্যাংক নেই। ব্যাংকের ম্যানেজাররা গ্রাহকদের আশ^স্ত করে যাচ্ছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে বলে বিদায়ও দিচ্ছেন; কিন্তু পরিস্থিতি আর স্বাভাবিক হচ্ছে না। গ্রাহকেরাও আর টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। সাংবাদিকেরা যখন বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক বা অন্যান্য কর্মকর্তাদের কাছে কথা বলতে চাইলেন কেউ তাতে সাড়া দিল না। বলা হলো, শাখায় কথা না বলে হেড অফিসে চলে যেতে। কিন্তু হেড অফিসে গিয়েও প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে পারলেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক কোনো অর্থ ধার করতে পারছে না। সে অবস্থা ব্যাংকটির নেই। ধাপে ধাপে পরিশোধ করতে হচ্ছে কর্মচারীদের বেতন। তারল্য সংকটে নতুন ঋণ বিতরণও বন্ধ। টানা লোকসান, মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণে খাদের কিনারে পৌঁেছ গিয়েছে ব্যাংকটি। একাধিক শাখা এতটাই নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছে যে মাত্র ৫০ হাজার টাকার চেকের বিপরীতেও গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না। কয়েক বছর ধরে ব্যাংকটি লোকসানে আছে এবং ২০২৩ সালে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এমনকি লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লভ্যাংশ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক।
এই ব্যাংকের গ্রাহকদের এরকম একটি অসহায় পরিস্থিতি দেখে অন্য অনেক ব্যাংকের গ্রাহকেরাও শংকায় পড়ে গিয়েছেন। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষ- যারা কষ্টের উপার্জন থেকে অল্প অল্প করে কিছু টাকা সেইভ করে ব্যাংকে জমিয়েছেন তারা ঐ টাকার নিরাপত্তা নিয়ে শংকায় পড়ে গিয়েছেন। কোনো একদিন টাকা তুলতে গিয়ে যদি নিজের ব্যাংকের এই হাল দেখেন তাহলে তারা কীভাবে তা সামাল দেবেন কিংবা সম্ভাব্য বিপর্যয় কীভাবে মোকাবেলা করবেন তা নিয়েও অনেকের মাঝেই দুশ্চিন্তা দেখা যাচ্ছে।
বিগত বছর কয়েক ধরেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে নেতিবাচক, দুর্বল ও বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে ব্যাংকিং সেক্টর। এই সেক্টরের লুটপাট, ব্যাংক দখল, ঋণ খেলাপি কিংবা ভুয়া কোম্পানীর পরিচয় দিয়ে শত কোটি টাকা লোপাটের খবর নিয়মিতভাবেই মানুষ জানতে পারছে। এগুলো নিয়ে এমনিতেই মানুষের মাঝে ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা রয়েছে। তার মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এই করণ দশা গ্রাহকের দুশ্চিন্তার আগুনে অনেকটা যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতে সার্বিক তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনা সমানভাবে বণ্টন হচ্ছে না। এতে কোনো ব্যাংকে রয়েছে অতিরিক্ত তারল্য, আবার কোনো ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। জনগণের ভোগান্তি বা প্রতিদিন অসংখ্য অনিয়মের খবর প্রকাশিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকটা দায়সারাভাবে বা গতানুগতিকভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যাচ্ছে। ব্যাংকে টাকার সংকটের কথা যেমন তারা অস্বীকার করছে তেমনি তারল্য সংকট বলেও কিছু আছে বলে তারা মানতে চাইছেন না। তারা দাবি করছেন, দেশে তারল্যের কোনো সংকট নেই বরং অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।
অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত। টাকার অভাবে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ দিতে পারছে না। শাখাগুলোর ঋণ দেয়ার ক্ষমতা অনেকটা সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। সংগ্রহ করা আমানতের চেয়ে অনেক ব্যাংক বেশি ঋণ দিয়েছে যার ফলে তাদের হাতে এখন বাড়তি অর্থ নেই। যে কারণে তারা নতুন করে কোনো ঋণ দিতে পারছে না। কয়েকটি ব্যাংকের সংকট এতটাই তীব্র যে তারা নিজেদের নিয়মিত প্রয়োজনও মেটাতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অর্থ ধার নিচ্ছে। অন্য ব্যাংক থেকে বা কলমানি থেকে ধার করতে গিয়েও তারা পাচ্ছে না। কেননা সব ব্যাংকেই এখন ঋণের চাহিদা বেশি। যে কারণে কলমানিতেও লেনদেন কমে গেছে। ফলে আর্থিক অবস্থা দুর্বল এমন ব্যাংকগুলো সংকটে পড়েছে। এদিকে যেসব ব্যাংকে বাড়তি তারল্য আছে তারাও নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যদিও বাহ্যত তারা ভালো বিনিয়োগকারী বা উদ্যোক্তা না পাওয়ার দাবি করছে।
এসব কারণে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমে গিয়েছে। এ ছাড়া ঋণ আদায়ও কমে গেছে। বেশিরভাগ ব্যাংক এখন নতুন ঋণ দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। বরং বাস্তবতার নিরিখে প্রায় সব ব্যাংকই এখন পুরনো ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছেন। কিন্তু ঋণের টার্ন-ওভারের হারও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি ও অনিয়ম এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকেরাও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তারা আইনের ও সিস্টেমের নানা ফাঁকফোঁকরের সুবিধা নিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, ঋণের বড় অংশই এখন ফেরত আসছে না। আরো বছর দুয়েক আগেই বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক গবেষণায় জানিয়েছিল, এর আগের ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতে আলোচিত বড় ধরনের ১০টি জালিয়াতির ঘটনায় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গেছে। বর্তমানে এ পরিমাণ আরো অনেকটা বেড়ে গেছে যার প্রায় সবটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
সাধারণ মানুষ নিজেদের অল্প কিছু পাওনা টাকা পাওয়ার জন্য হণ্যে হয়ে ঘুরলেও ব্যাংকখাতকে ছিদ্র করে দিয়ে গেছে এক শ্রেণীর অসৎ মানুষ যারা উদ্যোক্তা পরিচয়ে এসে নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা বের করে নিয়েছে। বিশেষ করে ঋণখেলাপি হয়ে এবং খাস জমি মর্টগেজ রেখে তারা বড়ো অংকের ঋণ নিয়েছে। ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নাম ভাঙিয়ে তার পরিচিত লোকেরা কোম্পানী খুলে বড় অংকের টাকা ঋণ নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছে। এমনকি, ভুয়া বন্ধকি নিয়েও ঋণ ইস্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঋণগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আর আদায় করতে পারছে না। এগুলো খেলাপি হয়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে উল্টো ব্যাংকের দ্বিগুণ পরিমাণ তহবিল আটকে যাচ্ছে। আর প্রকৃত উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেছেন, ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় নিজেদের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পারছেন না।
সুইস ব্যাংকে বিগত এক যুগে অসংখ্য টাকা পাচার করা হয়েছে। ২০২২ সালের শুরতে পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছিল। এর মধ্যে পানামা পেপারসে ৪৩ ও প্যারাডাইস পেপারসে ২৬ জনের নাম রয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ তালিকা তৈরি করেছিল। তালিকায় সংশ্লিষ্টদের নাম থাকলেও কে কত টাকা পাচার করেছেন তা উল্লেখ ছিল না। কিন্তু এরপর দুই বছর চলে গেলেও সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি মানুষ জানতে পারেনি। ফলে, একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে মানুষের আস্থা যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি আর্থিকখাতে অনিয়মকারীরাও এক ধরনের ইমিউনিটির সুবিধা পেয়েছেন।
সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের মতো ঠিক একইভাবে জনগণের কষ্টের টাকা লুটপাট করে কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে বিলাশ বহুল বাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১১ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রকৃত পরিমাণ হয়তো আরো বেশি। রাঘব বোয়াল তো আছেই, ছোট ও মাঝারি পর্যায়েরও ঋণ খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই হাজার কোটি টাকা বা শত কোটি টাকার ঋণ আত্মসাতের গল্প সামনে এনে নিজেদের কোটি টাকার ঋণগুলোকে ছোটখাটো বিষয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। ঋণ পরিশোধ না করে বিলাসী জীবন যাপনের চিত্র সমাজে খুবই স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এগুলো যে দেশের টাকা, দেশের মানুষের টাকা কিংবা এই টাকাগুলো পরিশোধ করার যে দায়বদ্ধতা- এ ধরনের নৈতিক বোধ অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতার মধ্য থেকে যেন হারিয়েই গিয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের অবৈধ সুবিধা দেয়ার স্বার্থে অযৌক্তিক ঋণ অবলোপন ও পুনঃতফসিলকরণের নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। যারা কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, তাদেরকে অযাচিত সুবিধাদি দিলেও যৎসামান্য ঋণের দায়ে গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার নানা খবরও আমাদের সামনে আসছে। অর্থাৎ গ্রাহক পর্যায়ে যেমন ঋণ পরিশোধ দিয়ে নৈতিক দায়বদ্ধতা কাজ করছে না তেমনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও অবৈধ সুবিধার বিনিময়ে নানা অনিয়মকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি এসব অনিয়ম দেখার জন্য রেগুলেটরি যে প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সেগুলোও বেড়ায় ক্ষেত খাওয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
সীমাহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত রেমিটেন্স প্রবাহে মন্থর গতি সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত বাংলাদেশে দুই ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে বড় পরিমাণ রেমিটেন্স প্রবেশ করে। কিন্তু গত রোজার ঈদে রেমিটেন্সের পরিমাণও আশানুরূপ ছিল না। অনেকেই এর একটি কারণ হিসেবে বলছেন, ব্যাংকের ডলারের রেটের চেয়ে বাইরের রেট ভালো পাওয়ায় মানুষ হুন্ডির ওপর ভরসা করেছে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন রয়ে যায়, হন্ডিকে অবৈধ ব্যবসা হিসেবে চিত্রায়িত করে শেষ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোই কি আবার গ্রাহকদের হুন্ডি ব্যবসার দিকে ঠেলে দিলো?
এরকমই পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ ব্যাংক একদিনে ডলারের মূল্য ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করেছে। খোলা বাজারে প্রতি ডলার অবশ্য ১২৫ টাকার নীচে পাওয়া যায় না। ডলার না থাকায় ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। গত রোজার মাসে খেজুরসহ অনেক প্রয়োজনীয় পণ্য মানুষকে চড়া দামে খেতে হয়েছে কারণ ব্যবসায়ীরা সময়মতো এলসি করতে পারেননি। শুধু তাই নয় ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এমনকি জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পর্যন্ত আমদানি করা যাচ্ছে না। ডায়বেটিসের ইনসুলিনসহ ক্রিটিকাল যেসব ওষুধ বাহির থেকে আসে, অনেক ফার্মেসিতে এরই মধ্যে এ ধরনের ওষুধের সংকট দেখা দিয়েছে।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আমদানিকৃত খাদ্যে, খাদ্য উৎপাদনে এবং বীজ ক্রয়সহ খাদ্য আমদানি বা উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দাম বেড়েছে। মানুষ কোনো খাবারই এখন কম দামে খেতে পারছে না। মাত্র বছর খানেকের ব্যবধানে প্রতিটি খাবারের দাম অন্তত দ্বিগুণ বেড়েছে। খাদ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ৯.৮১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, দেশের ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে ভুগছে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলো শুধু মূলধন নয় বরং অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়ে কোনোরকমে চলার চেষ্টা করছে। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং ডলারের চাহিদা পূরণ করার জন্য সরকার ২০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের জন্য আবেদন করেছে।
ব্যাংকখাতের অচলায়তন এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর অবস্থা উন্নত করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ৫টি দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এই খবরে আতংকিত হয়ে গ্রাহকেরা বিপুল হারে টাকা তুলতে শুরু করায় এবং সংশ্লিষ্ট দুর্বল ব্যাংক বা সবল ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আগ্রহ না থাকায় সে সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় যে ব্যাংকগুলো আছে সেগুলো ছাড়া নতুন করে আর কোনো ব্যাংককে একীভূত করা হবে না। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং কিছু ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থা কমায় গত বছরের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে টাকা জমানোর পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। ফলে, ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বাড়ছে। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের গ্রাহকেরা টাকা তুলতে পারছেন না-এ ধরনের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার পাওয়ায় আগামীতে গ্রাহক পর্যায়ে টাকা তুলে নেওয়া কিংবা ব্যাংকে টাকা জমা না রাখার প্রবণতা আরো বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদগণের মতে, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর বেশ কিছু কারণে দুর্বল হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না; জালিয়াতি করে ঋণ নেওয়া; ব্যাংক মালিক হওয়ার সুবাদে অনিয়ম করা, রাজনৈতিক মদদে নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি বা পরিচালনা পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংকঋণ ও লুটপাট করা; লুণ্ঠনের মাস্টারমাইন্ডদের বিচারের মুখোমুখি করতে না পারা, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার না করা প্রভৃতি। সর্বোপরি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও নীতি বহির্ভূত মানসিকতা অন্য আরো অনেক সেক্টরের মতো ব্যাংক সেক্টরকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর যে সমস্যাগুলো সামনে আসছে, সংশ্লিষ্ট মহল যদি সেগুলো অস্বীকার করে কেবলই গতানুগতিক বা ফরমায়েসী আলাপ ও পদক্ষেপেই ব্যস্ত থাকেন, তাহলে চলমান সংকট যে আরো ঘনীভূত হবে তা বলাই বাহুল্য।