ফের ডিমের বাজারে নৈরাজ্য চালাচ্ছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ভোক্তার পকেট কাটতে আলুর হিমাগারে অবৈধভাবে মজুত করা হচ্ছে ডিম। রাতারাতি সরবরাহ কমিয়ে অস্থির করা হয়েছে বাজার। শক্তিশালী চক্রটি প্রতিদিন আড়ত পর্যায়ে এসএমএসের মাধ্যমে ডিমের বাড়তি দাম নির্ধারণ করছে। সেই দাম কার্যকরের পর খুচরা পর্যায়ে হুহু করে বেড়েছে দাম। ফলে এক ডজন (১২ পিস) ডিম কিনতে ক্রেতার ১৬০ টাকা গুনতে হচ্ছে। যা দুই সপ্তাহ আগেও ১২০ টাকা ছিল। আর বাড়তি দামে পণ্যটি কিনতে নাজেহাল হচ্ছেন ভোক্তা। হিমাগার থেকে ডিম উদ্ধার হলেও কারও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রোববার বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুচরা বাজারে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি ডজন ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। যা দশ দিন আগেও ১২০-১২৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ফার্মের সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা। যা আগে ১১০-১২০ টাকা ছিল। সেক্ষেত্রে গত কয়েকদিনে ডজনপ্রতি বাদামি ও সাদা ডিমের দাম বেড়েছে ২৫-৩৫ টাকা।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, রাজধানীর তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান ডিমের দাম নির্ধারণ করে। হঠাৎ করে তারা দাম কমিয়ে দিয়ে খামারিদের থেকে ডিম নিয়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করে। এরপর সরবরাহ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করে। সূত্র জানায়, তেজগাঁও ডিমের আড়তে প্রতিদিন ১৫-২০ লাখ ডিম বিক্রি হলেও তারা সারা দেশে চার কোটি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন তারা সারা দেশের বিক্রেতা এবং খামারিদের বাজারদর এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। গত ২ মে তেজগাঁও আড়ত থেকে ডিমের দাম প্রতি ১০০ পিসে ১০ টাকা বাড়িয়ে বিক্রির নির্দেশ দেয়। ৩ মে এসএমএসে ৩০ টাকা বাড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ৪ মে ১০০ পিস ডিমের দাম ৫০ টাকা ও ৫ মে ৬০ টাকা বাড়িয়ে সমিতি মুঠোফোনে এসএমএস দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ জানান, গত মাসের গরমে লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। ডিম উৎপাদন ২৫-৩০ শতাংশ কম হয়েছে। তাই চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম হওয়ায় দাম বেড়েছে। তা ছাড়া কিছু মধ্যস্বত্বভোগীও ডিমের দাম বাড়াচ্ছে। কোনো আড়তদার ডিমের দাম বাড়াতে পারে না। চাহিদা থাকলে বাজারে দাম বাড়ে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, এপ্রিল মাসে দাবদাহে প্রায় এক লাখ মুরগি মারা গেছে। এর আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকা। তবে এপ্রিল মাসে যেসব মুরগি মারা গেছে তার জন্য পহেলা মে থেকে ডিমের দাম বেড়েছে এমনটা বলা যাবে না। কারণ চার দিন পরপর ডিম ব্যবসায়ীরা খামারিদের থেকে ডিম কেনেন। ফলে এক তারিখ থেকে দশ তারিখ পর্যন্ত তারা নিজেদের স্বার্থে দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, ডিমের বাজারে শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। গতবার দাম বাড়ালে তদারকি সংস্থা তাদের ডেকেছে, কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি। তাই এবারও তারাই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। সিন্ডিকেটের মধ্যে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ও করপোরেট কয়েকটা প্রতিষ্ঠান জড়িত। তারা চাইলে দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার তারা তাদের ইচ্ছাতেই দাম কমে। পহেলা মে খামারে যে ডিমের দাম ছিল আট টাকা ২০ পয়সা, ২ থেকে ১১ মে পর্যন্ত তারা দাম বাড়িয়ে বিক্রি করায় বাজারে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু খামারে ডিমের দাম এক টাকাও বাড়েনি। প্রান্তিক খামারিরাও সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়।
জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ডিম নিয়ে ফের বাজারে অস্থিরতা চলছে। কেন দাম বাড়ছে তা সামনে আসছে। ইতোমধ্যে দেশের কয়েক অঞ্চলের হিমাগার থেকে অবৈধভাবে মজুত করা ডিম ধরা পড়ছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের কারসাজিও সামনে এসেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদারকি সংস্থা কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কে বা কারা কারসাজি করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় এনে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গার হিমাগার থেকে নামে-বেনামে মজুত করা ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। অধিদপ্তরের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থা তদারকি করেছে। তবে বিদ্যমান ভোক্তা আইনে ডিম হিমাগারে সংরক্ষণ করা হলে সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই বাজারে ডিমের সরবরাহ ঠিক রাখতে অভিযান চলমান আছে।
হিমাগারে অবৈধভাবে মজুত করা হচ্ছে ডিম : খামার পর্যায়ে ডিমের দাম না বাড়লেও খুচরা বাজারে হুহু করে বেড়েছে। খুচরা বাজারে ডজন ১৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর এক পিস কিনতে ক্রেতার গুনতে হচ্ছে ১৪ টাকা। প্রান্তিক খামারিরা অভিযোগ করে রোজার পর থেকে তাদের কাছ থেকে কম দামে ডিম কিনে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট হিমাগারে ডিম সংরক্ষণ করেছে। এরপর সরবরাহ কমিয়ে অস্থির করেছে বাজার। এদিকে এরই মধ্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও মাঠ প্রশাসন গত কয়েকদিনে অভিযান চালিয়ে ডিম মজুতের বড় চালান পেয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় একটি হিমাগারে থাকা ২৮ লাখ ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া নরসিংদীতে একটি হিমাগার থেকে ২০ লাখ ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি ৯ মে নরসিংদী জেলার এমইএস স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ থেকে ১৪ লাখ পিস মজুত করা ডিম উদ্ধার করে। যা উদ্ধারের ২০ দিন আগে মজুত করেছিল। অভিযানে এসব ডিম দ্রুত খালাস ও বিক্রির জন্য বলা হয়। ১৫ মে বগুড়ার কাহালু উপজেলায় আফরিন কোল্ড স্টোরেজে প্রায় ৫ লাখ পিস ডিম অবৈধভাবে মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া ৭ দিনের মধ্যে ডিমগুলো বাজারে বিক্রির নির্দেশও দেওয়া হয়। ১৬ মে কুল্লিায় অবৈধভাবে ২১ লাখ ডিম ও ২৪ হাজার কেজি মিস্টির সিরা মজুত রাখায় এক কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এছাড়া ১৮ মে বগুড়ার সদর উপজেলায় সাথী কোল্ড স্টোরেজ-২ এ অবৈধ মজুতের ১ লাখ ডিম উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া কোল্ড স্টোরেজের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজারকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন বগুড়া সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাকিব হাসান চৌধুরী।
https://www.jugantor.com/index.php/todays-paper/first-page/806995