চলতি বছরের ১৩ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা। মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকার বাসিন্দা মো. মাহবুবুল হকের ফোনে একটি কল আসে। ফোন ধরার পর অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি নিজেকে ফারুক বলে পরিচয় দেন। ‘কোন ফারুক’ জিজ্ঞেস করতেই ওই ব্যক্তি বলেন, ‘তুই কোন ফারুককে চিনিস? একদিন তো বাহির হব। বুঝে–শুনে কাজ করিস।’
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ফারুক মতিঝিল থানার ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম (টিপু) হত্যা মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহমেদ (মানিক) ও জিসান আহমেদের সঙ্গে ওমর ফারুকও অভিযুক্ত। বর্তমানে তিনি কারাগারে। ১৩ মার্চ রাতে হুমকি দিয়ে যে নম্বর থেকে ফোন করেছিলেন, সেটির অবস্থান গাজীপুরের কাশিমপুরের গোবিন্দবাড়ির পূর্ব এনায়েতপুরে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে। এই এলাকায় কাশিমপুরের কারাগারগুলো অবস্থিত।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ কারাগারে থেকেও ফোন ব্যবহারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে কেউ না কেউ তাঁদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছেন।
তৌহিদুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওই ঘটনায় ১৪ মার্চ মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মো. মাহবুবুল হক। তিনি মতিঝিল এলাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি করছেন। ফোনে হুমকির বিষয়ে সম্প্রতি তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি চুপ হয়ে যান। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না বলে জানান।
কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরা যে চাঁদা চেয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফোন করেন, হুমকি দেন; এ অভিযোগ নতুন নয়। তাঁরা কারাগারে বসে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাসহ নানা ঘটনার পরিকল্পনাও করে থাকেন বলে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংবাদ সম্মেলনেও বলা হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকার অন্তত সাতজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগারে আছেন। তাঁরা হলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস ও খোরশেদ আলম ওরফের রাসু।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে কারাগার থেকে যেমন ফোন করেন, আবার আদালতে মামলার হাজিরা দিতে এসে সহযোগীদের ফোন থেকে বিভিন্ন জনকে ফোন করেন, হুমকি দেন। এ ক্ষেত্রে সরাসরি মুঠোফোন নম্বরের পরিবর্তে বেশির ভাগ সময় তাঁরা বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করেন। আলোচিত এসব সন্ত্রাসীর অধিকাংশ হুমকির ঘটনায় থানায় মামলা, জিডি বা অভিযোগ না দেওয়ায় এই ঘটনাগুলো নিয়ে তেমন তদন্তও হয় না।
কারাগারে থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ঘটনা যে একেবারেই অস্তিত্বহীন বা অমূলক, এটি বলা যাবে না। সন্ত্রাসীদের অনেকে কারাগারে থেকেই কখনো কখনো নিজেদের মধ্যে একধরনের ঐক্য বা বোঝাপড়া করেন। পরে জামিন পেয়ে বাইরে এসে তাঁরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার প্রচেষ্টা চালান। তবে কারাগারের ভেতরের বিষয়গুলো আমাদের এখতিয়ারভুক্ত না।’
ঢাকার অন্তত সাতজন শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগারে আছেন। তাঁরা হলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সোহেল রানা চৌধুরী ওরফে ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস ও খোরশেদ আলম ওরফের রাসু।
কারাবন্দী আব্বাসের দাপট মিরপুরে
প্রায় দুই দশক ধরে কারাগারে আছেন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. আব্বাস আলী। পুলিশের কাছে তিনি কিলার আব্বাস নামেও পরিচিত।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মিরপুরের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, আব্বাস কারাগারে থাকলেও মুঠোফোনের মাধ্যমে কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, ভাসানটেক, ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অপরাধজগতে তাঁর দাপট রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল এবং সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ ও মালামাল সরবরাহকারী ঠিকাদারদের থেকে চাঁদা আদায় করেন আব্বাস। এ ছাড়া নির্মাণকাজ, তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা, ঠিকাদারি, ডিশ ও ইন্টারনেটের লাইনের সংযোগ প্রদান থেকেও চাঁদা যায় তাঁর কাছে। তাঁর স্ত্রী হামিদা বেগমের নামে থাকা ‘হামিদা এন্টারপ্রাইজ’ গত বছর কচুক্ষেত বাজারের (রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট) কোরবানির হাটের ইজারা পান।
একবার কিলার আব্বাসের লোকজন অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার ১০-১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। বছর দেড়েক আগে আবার ৩০ লাখ টাকা চাঁদা চায়। সেটা না দেওয়ায় এক মাসের মাথায় তার বাহিনী এসে মিরপুর ১৪ নম্বর এজি ফ্যাশনের সামনে আমার ওপর হামলা করে। এক সপ্তাহ পর আবার হামলা করে। এখনো আমাকে হুমকি দিচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার মিরপুরের বাসিন্দা হেলেনা আক্তার
চাঁদা না দেওয়ায় আব্বাসের সহযোগীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মিরপুরের হেলেনা আক্তার নামের এক নারী। ১৪ মে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানান, একসময় গার্মেন্টসে নাশতা বিক্রি করতেন তিনি। সেখান থেকে পোশাক কারখানার ঝুট ও বাতিলকৃত মালামালের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে হেলেনাকে নানাভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছেন আব্বাসের লোকজন। এসব ঘটনায় একাধিক মামলা ও জিডি করেছেন এই নারী।
হেলেনা আক্তার বলেন, ‘একবার কিলার আব্বাসের লোকজন অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার ১০-১৫ লাখ টাকার মালামাল লুট করে। বছর দেড়েক আগে আবার ৩০ লাখ টাকা চাঁদা চায়। সেটা না দেওয়ায় এক মাসের মাথায় তার বাহিনী এসে মিরপুর ১৪ নম্বর এজি ফ্যাশনের সামনে আমার ওপর হামলা করে। এক সপ্তাহ পর আবার হামলা করে। এখনো আমাকে হুমকি দিচ্ছে।’
আব্বাসের সম্পর্কে জানেন স্থানীয় এমন এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জেলে থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ থাকা ফোন ব্যবহারসহ অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান আব্বাস। বিভিন্ন সময় কারাগার থেকে মামলার হাজিরা দিতে আদালতে আসা-যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অনুসারী বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলেও এলাকায় প্রচার আছে।
কারাগারে থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ, মুঠোফোন ব্যবহার করে চাঁদার জন্য হুমকি, আদালতে যাওয়া–আসার পথে সহযোগী ও পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে এই প্রতিবেদক কয়েক দিন ধরে চেষ্টা করেন। কারা মহাপরিদর্শক, অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক, সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক, কারা উপমহাপরিদর্শক (ঢাকা) ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলারের ফোনে কয়েক দফা কল করে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পরিবহন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো ঘটনায় পিচ্চি হেলালের লোকজন জড়িত। বিভিন্ন সময় এমন কয়েকটি ঘটনায় পিচ্চি হেলালের অন্তত পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
থেমে নেই পিচ্চি হেলাল
প্রায় এক ডজন খুনের মামলার আসামি সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৩ সালে মোহাম্মদপুরে চলচ্চিত্র অভিনেতা খলিল উল্লাহ খানের ছেলে বাবুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হেলালের উত্থান হয়। তিনি তখনকার আরেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদের (যোসেফ) প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। ২০০০ সালের ১২ জানুয়ারি হেলাল গ্রেপ্তার হন।
দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকলেও মোহাম্মদপুরে পিচ্চি হেলালের সহযোগীরা সক্রিয়। তাঁর বিরুদ্ধে গত এক বছরে মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় লোকজন একাধিকবার মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পরিবহন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নির্মাণকাজ থেকে চাঁদাবাজি এবং জমি দখলের মতো ঘটনায় পিচ্চি হেলালের লোকজন জড়িত। বিভিন্ন সময় এমন কয়েকটি ঘটনায় পিচ্চি হেলালের অন্তত পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। কারাগারে থাকলেও ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনার কে এম আহমেদ রাজু হত্যায় পিচ্চি হেলালের সম্পৃক্ততার তথ্য পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর মোহাম্মদপুরে তছির উদ্দিন হত্যায়ও তাঁর নাম এসেছে।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ ওরফে টিপু হত্যা মামলার আসামি ইমন। তিনি ২০০৫ সালে দেশ ছেড়ে পালান। কলকাতা পুলিশ তাঁকে ২০০৮ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর সহযোগীরা হাজারীবাগ ও আশপাশের এলাকায় অপরাধজগতে সক্রিয়।
ইমন এখনো হাজারীবাগে ত্রাস
হাজারীবাগে ঘুরে জানা গেছে, বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা ও ঠিকাদারির কাজ করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখোমুখি হন অনেকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় কারাবন্দী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের নাম। তিনি অপরাধজগতে ক্যাপ্টেন ইমন নামেও পরিচিত।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ ওরফে টিপু হত্যা মামলার আসামি ইমন। তিনি ২০০৫ সালে দেশ ছেড়ে পালান। কলকাতা পুলিশ তাঁকে ২০০৮ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এর পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন। তাঁর সহযোগীরা হাজারীবাগ ও আশপাশের এলাকায় অপরাধজগতে সক্রিয়।
হাজারীবাগের কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে রেখে মোটরসাইকেল নিয়ে ইমনের সহযোগীরা বিভিন্ন সড়কে মহড়া দেন। চাঁদাবাজির জন্য তাঁরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হন ঈদের আগে।
এ বিষয়ে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ ১২ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই থানায় যোগদানের পর ক্যাপ্টেন ইমনের নামে ফোন আসার কথা শুনেছি। তবে অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেনি।’
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ে জামিনে মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ ওরফে মামুনকে গুলি করা হয়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ভুবন চন্দ্র শীল নামের এক আইনজীবী নিহত হন। পরে পুলিশের তদন্তে আসে, স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগার থেকে তাঁর একসময়ের বন্ধু মামুনকে গুলি করান। মামুন ১৫ মে এক মামলায় হাজিরা দিতে গেলে আদালত তাঁকে আবার কারাগারে পাঠান।
এর আগে ২০১৩ সালে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সভাপতি আফজাল হোসেন সাত্তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও কারাগারে থাকা ইমনের নাম আসে।
আমি এই থানায় যোগদানের পর ক্যাপ্টেন ইমনের নামে ফোন আসার কথা শুনেছি। তবে অভিযোগ নিয়ে কেউ থানায় আসেনি।
হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ
বিদেশে থাকা ও কারাবন্দী সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কারাবন্দী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটা যোগাযোগ রয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাঁরা সহযোগীদের দিয়ে ঢাকায় একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য পেয়েছে।
বছর দুই আগে চাঁদাবাজির অভিযোগে ঢাকার বাড্ডা ও বান্দরবান থেকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন সাতজন। অনুসন্ধানে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে, এই আসামিরা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। ২০০৬ সালে চার খুনের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি বাড্ডার মামুনের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল। অপরদিকে বিদেশে থাকা জিসানও কারাগারে থাকা মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
বেশির ভাগ সময় ফোন করে তারা লোক পাঠিয়ে দেয়। কখনো নাম উল্লেখ করে বলে তার লোক সাক্ষাৎ করবে। কখনো আবার বলে ওমুক সালাম দিতে যাবে। তখনই তাঁরা বুঝে নেন চাঁদার কথা বলছে।
মোহাম্মদপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ী
ফোনে সাংকেতিক ভাষা
কারাগারে থেকে চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো নিয়ে মামলা-জিডি খুব বেশি না হলেও বিভিন্ন সময় হুমকি দেওয়া কথোপকথনের রেকর্ড আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পেয়েছে। বিষয়গুলো কারা কর্তৃপক্ষের নজরে যাওয়ায় কোনো কোনো সময় সন্ত্রাসীদের থাকার কক্ষগুলোতে তল্লাশিও হয়েছে। এ কারণে ফোনে হুমকি ও চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহারে অনেক কৌশলী হয়েছে কারাবন্দী সন্ত্রাসীরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র থেকে চলতি বছর রোজার আগে কারাগার থেকে চাঁদা চাওয়ার একটি ফোন কলের তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে এক ঠিকাদারের উদ্দেশ্যে মতিঝিল এলাকার এক সন্ত্রাসীকে বলতে শোনা যায়, ‘রোজা আইসা পড়ছে তো। বাজার-টাজার করতে হবে? জোগাড় হয়েছে?’
দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে চাঁদা দেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে মোহাম্মদপুর অঞ্চলের এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশির ভাগ সময় ফোন করে তারা লোক পাঠিয়ে দেয়। কখনো নাম উল্লেখ করে বলে তার লোক সাক্ষাৎ করবে। কখনো আবার বলে ওমুক সালাম দিতে যাবে। তখনই তাঁরা বুঝে নেন চাঁদার কথা বলছে।’
ফোনকারীকে শনাক্ত করা যায় না
গত দুই বছরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১২টি জিডি ও অভিযোগ ধরে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। পরে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের হুমকির ঘটনায় ব্যবহার হওয়া ১০টি ফোন নম্বর বিশ্লেষণ করা হয়। নম্বরগুলো হলো: +৯৭১৫৪৫৪৩৭১৯৮, +৫২৯৪০, +৬৬৯৬৮৫০৭৬৫৭, +৬০১৬৩৪৬৪২৪৭, +৫৫৫৮৭৭, +৯২৯৭২৮২৩ ও +৮৮২৩৯১।
অপর তিনটি ফোন নম্বর বাংলাদেশি; যেগুলো এখন বন্ধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, এই তিনটি ফোন নম্বর যাঁদের নামে নিবন্ধিত, তাঁরাও এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
আর অন্য সাতটি ফোন নম্বর সম্পর্কে জানতে দুটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, এগুলো সাধারণ কোনো বিদেশি নম্বর নয়। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত পরিচয় গোপন করে এই নম্বরগুলো থেকে কল করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত পরিচয় ও অবস্থান জানা কঠিন হয়ে পড়ে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ কারাগারে থেকেও ফোন ব্যবহারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে কেউ না কেউ তাঁদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক
কারাগারেই থাকতে চান অনেকে
ঢাকার অপরাধজগৎ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আলোচিত সন্ত্রাসীদের অধিকাংশ মামলায় সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দেন না। এ জন্য চূড়ান্ত বিচারে গিয়ে অনেক মামলায় তাঁরা পার পেয়ে যান। এভাবে শাস্তির ভয় কমে যাওয়ায় কারাগার থেকে বের হতে চান না অনেক সন্ত্রাসী। বাইরে বের হলে পুনরায় গ্রেপ্তারের আশঙ্কা কিংবা প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী দলের হামলা থেকে বাঁচতে কারাগারকেই নিরাপদ জায়গা মনে করেন অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী। এ জন্য বছরের পর বছর পার হলেও তাঁদের অনেকেই সব মামলায় জামিন আবেদন করেন না। অনেকে আবার বেশির ভাগ মামলায় পেলেও কেবল দু-একটি মামলায় আর জামিনের আবেদন করেন না।
কারাগার থেকে সন্ত্রাসীদের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ কারাগারে থেকেও ফোন ব্যবহারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। সেটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা বাইরের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর্থিক সুবিধা নিয়ে কেউ না কেউ তাঁদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিচ্ছেন।’
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞের মতে, অবৈধ লেনদেন থেকে কারাগারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যতক্ষণ পর্যন্ত বের হতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।