আমরা খুবই ভয়ে আছি। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। এখন আমরা একসঙ্গে সময় পার করছি। বাইরে যাচ্ছি না। মজুত খাবার শেষ হয়ে আসছে। ভয়ে বাইরে যেতে ভয় করছে। মানবজমিনকে এভাবেই পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলেন কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী আজমাইন মো. সাদ। দেশটির রাজধানী বিশকেকে অধ্যয়নরত এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো। শিক্ষক ও প্রশাসনের লোকজন স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন। শহরজুড়ে ২ হাজার ৭০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
আতঙ্কিত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা নিরাপদে আছেন। পরিস্থিতি আরেকটু শান্ত হলে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা চার্টার্ড বিমানে করে দেশে ফিরবেন। বিশকেকে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা একত্রে অবস্থান করছেন। কিরগিজস্তানে প্রায় ১২০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছেন। যাদের অধিকাংশই মেডিকেল শিক্ষার্থী। দেশটিতে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছেন। স্থানীয় সময় ১৬ই মে রাতে হামলা শুরু হয় বিদেশি শিক্ষার্থীদের ডরমেটরিতে। এরপর হামলা হয় ভাড়া ফ্ল্যাট ও মেসগুলোতে।
সরকারি একটি মেডিকেলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাদ আরও বলেন, আমরা এখনো সতর্কভাবে অবস্থান করছি। বাইরে বের হচ্ছি না। যদিও বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কেউ গুরুতর আহত হয়েছেন এমনটা শুনিনি। আমরা যারা ভাড়া বাসায় মেস করে থাকি কিছুটা নিরাপদে আছি। যারা ডরমেটরিতে থাকেন তারা ভয়ে আছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, মিশরীয়দের সঙ্গে স্থানীয়দের মারামারির ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে উত্তেজনার আভাস পাই। ডরমেটরির বাইরে স্থানীয়রা জটলা শুরু করে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হামলা চালায়। আমাদের হোস্টেলগুলো হামলা করে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। আমরা সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে চলে যাই।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সিয়াম সালমান মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয়রা নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে। তারা ছেলেমেয়ে যাকেই পেয়েছে তার শরীরেই আঘাত করেছে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে শুনিনি।
আনিসুর রহমান মাহমুদ বলেন, প্রথমে ডরমেটরিতে থাকা বিদেশি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়। যারা ভাড়া ফ্ল্যাটে বা মেসে থাকতো তারা নিরাপদ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে গ্রুপ করে এসব জায়গায় জায়গায় এসে নক করা শুরু করে। ফ্ল্যাটে ঢুকতে না পেরে সামনে যা পেয়েছে তাতেই আঘাত করেছে। আমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাই। একেক জায়গায় কয়েকজন করে অবস্থান করি। তারা কাঁচের যেসব গ্লাস পেয়েছে সবকিছুই ভেঙে দিয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কেউ আহত হয়েছেন বলে শুনিনি।
বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। আগে পুলিশ সাহায্য না করলেও এখন তারা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আমরা অনেকেই নিজ নিজ আবাসস্থলে ফিরেছি, ফিরছি। তবে আতঙ্কে রয়েছি সবাই। আমরা বাইরে বের হচ্ছি না খুব প্রয়োজন ছাড়া। শহর জুড়ে পুলিশ রয়েছে। বিশেষ করে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর সামনে নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই কিরগিজস্তানে অধ্যয়ন করছেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। তবে গত ১২ই মে মিশরীয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের বাদানুবাদ হয়। এই ঘটনায় পরদিন মিশরীয় শিক্ষার্থীরা স্থানীয়দের আঘাত করে। এরই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন স্থানীয়রা। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাতে হামলা চালান তারা। বিশেষ করে সরকারি মেডিকেল কলেজের ডরমেটরিতে থাকা শিক্ষার্থীরা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন।
ঘটনার দিনে সাহায্য চেয়ে ভিডিও করেন অনেকেই। একটি ভিডিওতে দেখা যায় হোটেল রুমে ‘৫০ জন’ অবস্থান করছেন। তারা বলছেন, তারা যাদেরকেই পারছে তাদেরকেই মারছে। আরেকজন বলেন, পুলিশের সামনে একজন বাংলাদেশি ও একজন ভারতীয়কে ভয়াবহভাবে মারধর করে। পুলিশ সেটা না রুখে ভিডিও করেছে।
খণ্ড খণ্ড কয়েকটি ভিডিওতে শিক্ষার্থীরা বলেন, ভারতীয় দূতাবাস হটলাইন নাম্বার দিয়েছে- সাহায্য করছে। পাকিস্তানি দূতাবাসও তাই করেছে। কিন্তু আমাদের এখানে দূতাবাস না থাকায় আমরা সব থেকে বেশি বিপদের মুখে আছি। আমাদের খাবার সংকট রয়েছে। সামনে কী হবে জানি না। আমি রুম থেকে বের হতে পারছি না। খুব শোচনীয় অবস্থা চলছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শ্রমিক হিসেবে যারা আছেন সবাইকে মারছে।
গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশকেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি ড. জেরিত ইসলাম বলেন, রোববার রাত থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের হোস্টেলে বড় কোনো হামলা হয়নি। কিন্তু কিছু স্থানীয় তরুণ বিদেশিদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে ও লুটপাট চালিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি সত্ত্বেও এখনো বিদেশি শিক্ষার্থীদের তাদের নিজ হোস্টেল ও অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বের হয়ে না আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা জুনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু এখন তারা চার্টার্ড ফ্লাইটে করে দেশে ফিরে পরবর্তীতে অনলাইনে পরীক্ষা দেবেন।
কিরগিজস্তানে বাংলাদেশি দূতাবাস না থাকায় উজবেকিস্তানের দূতাবাসের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। তাসখন্দ (উজবেকিস্তান) বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার মো. নাজমুল আলম মানবজমিনকে বলেন, যেহেতু কিরগিজস্তানে বাংলাদেশ দূতাবাস নেই। আমরা শিক্ষার্থীদের যথাসাধ্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আমরা রোববারই শিক্ষার্থীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কিরগিজস্তান সরকারকে অনুরোধ করেছি। এখন পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। আমরা এখনো কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে শুনিনি। তিনি আরও বলেন, আমরা যেকোনো সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত আছি।