শেয়ারবাজারে টানা দুই সপ্তাহের দর পতন মাত্রা ছাড়াতে চলেছে। এক দিনে কোনো শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না, দর পতন ঠেকাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) এমন নিয়মের পরও থামছে না দর পতন। গতকাল রোববার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া ৮৭ শতাংশের বেশি শেয়ার দর হারিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশের কোনো ক্রেতা ছিল না।
এই দর পতনে প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৮৬ পয়েন্ট হারিয়ে ৫৪৩১-তে নেমেছে। সূচক পতনের হার ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি বছর এটি এক দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পতনের ঘটনা। এর আগে গত ২১ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ৯৬ পয়েন্ট হারায় সূচক। তখন অবশ্য এক দিনে কোনো শেয়ারের দর ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমার সুযোগ ছিল।
গতকালের দর পতনে ডিএসইএক্স সূচক গত তিন বছরেরও বেশি সময় আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল সূচক ৫৪২২ পয়েন্ট থেকে ওঠার পর মাঝের ৩৭ মাসে দর পতন হলেও সূচকটি কখনোই এ পর্যায়ে নামেনি।
এ অবস্থায় হাল ছেড়ে দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। কিছুদিন ধরে যে দর পতন চলছে, তা শিগগিরই থামবে– এমন বিশ্বাস তারা হারিয়ে ফেলছেন। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়ছেন। গত সপ্তাহেও দুই হাজারের বেশি বিনিয়োগকারী তাদের পুরো শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছাড়েন। চলতি বছরের প্রথম থেকে হিসাব করলে এ সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে।
দর পতন চলতেই থাকবে– এমন শঙ্কা থেকে এখন অনেক বিনিয়োগকারী লোকসানেও শেয়ার বিক্রি করতে চাইছেন। কয়েক দিন ধরে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির বিপুলসংখ্যক শেয়ারহোল্ডার শেয়ার বিক্রির আদেশ দিচ্ছেন; কিন্তু ক্রেতা মিলছে না।
গত ৭ মে ঢাকার শেয়ারবাজারে ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে গতকালের লেনদেন ৬৩ শতাংশ কমে ৪০৯ কোটি টাকায় নেমেছে। এ অবস্থায় শেয়ার বিক্রি করে শেয়ারবাজার ছেড়ে দেওয়ারও সুযোগ কমছে।
গতকালের হিসাবে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩৯৬ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৪৬টি দর হারিয়েছে। দর বেড়েছে মাত্র ২২টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৯টি শেয়ারের। ক্রেতার অভাবে ৯টি শেয়ারের কেনাবেচা হয়নি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, লেনদেনের মধ্যে ৩০০ কোম্পানির শেয়ার সার্কিট ব্রেকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন দরে কেনাবেচা হয়েছে। এর মধ্যে শেয়ার ২৭০টি এবং মিউচুয়াল ফান্ড ৩০টি। সর্বশেষ লেনদেন মূল্যের হিসাবে ২০১ শেয়ার এবং ১৯টি মিউচুয়াল ফান্ড ওই দরে পড়ে ছিল। এসব শেয়ার ও ফান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশের ক্রেতা ছিল না।
দর পতন রুখতে ২০২২ সালের জুলাইয়ে তালিকাভুক্ত সব শেয়ারের দরে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দরসীমা বেঁধে দেয় বিএসইসি। দেড় বছর পর গত ২১ জানুয়ারি এ নিয়ম তুলে নেওয়ার দিনই সিংহভাগ শেয়ার দর হারায়। এরপর দর পতন রোধে কিছু কৃত্রিম ব্যবস্থা নিয়ে এক সপ্তাহ দর পতন ঠেকিয়ে রাখা হয়। তবে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন করে দর পতন শুরু হলে তা চলে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এতে ডিএসইএক্স সূচক ৯২৮ পয়েন্ট হারায়।
এ দর পতন রুখতে না পেরে ফের হস্তক্ষেপ করেছে বিএসইসি। গত ২৪ এপ্রিল আদর্শ (স্ট্যান্ডার্ড) সার্কিট ব্রেকারের বিধান পাল্টে দিয়ে এমন নিয়ম করে দেয়, যাতে একদিনে কোনো শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। এতে কয়েক দিন শেয়ারের দরের পতন বন্ধ হলেও নতুন করে দর পতন শুরু হয়েছে।
দুই সপ্তাহ ধরে চলা দর পতনে ৩১৬ শেয়ার ও ফান্ড দর হারিয়েছে; যার ১০৩টির দর পতন হয়েছে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশ। এতে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণও বেশ কমেছে। গত ৭ মে যেখানে ঢাকার শেয়ারবাজারে ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়, গতকাল তা ৪০৯ কোটি টাকায় নেমেছে।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা এ দর পতনের জন্য শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সরাসরি হস্তক্ষেপ, ভুল নীতি এবং কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে নমনীয় অবস্থানকে দায়ী করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ সমকালকে বলেন, একদিনে কোনো শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না, এ নিয়মটাই দর পতনের বড় কারণ বলে মনে করি। কোনো শেয়ারের দর পতন শুরু হতে থাকলে ৩ শতাংশ কমার আগেই বিক্রেতা বেড়ে যায়, ক্রেতারা সরতে থাকে। দর পতন ঠেকাতে গিয়ে বাজারকে স্থায়ী দর পতনের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয় বলে মনে করেন এ অর্থনীতির শিক্ষক।
তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেও রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। আগামী জুনে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রাখার শর্ত দিলেও এখন আইএমএফ তা কমিয়ে ১৪ বিলিয়নে নামিয়ে এনেছে। এভাবে রিজার্ভ কমতে থাকলে আমদানি ব্যাহত হবে, সঙ্গে রপ্তানিও ব্যাহত হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। ফলে বিনিয়োগকারীরা আগাম সতর্কতা হিসেবে শেয়ার বিক্রি করছেন। এতে দর পতন বাড়ছে।
শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কর বসানো হবে বলে যে খবর বেরিয়েছে, দর পতনে তার একটা প্রভাব আছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আল-আমীন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে দর বাড়ে কম সময়, কমে বেশি সময়। এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মুনাফা করতে পারেন না। যারা বড় বিনিয়োগ করেন বা শেয়ার কারসাজি করে বড় অঙ্কের মুনাফা করেন, তারা অনেকে নিজের নামে শেয়ার কেনাবেচা করেন না। ফলে তার গেইন ট্যাক্স দেওয়ার প্রশ্ন আসছে না। অর্থাৎ সরকারে এ নীতি আদৌ বাস্তবায়ন হবে বলে মনে হয় না। তবে বাজারের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে।