নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছেই। দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষ। বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। অল্প আয়ের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। রমযানের পর থেকে জিনিসপত্রের দাম কমার পরিবর্তে উল্টো দফায় দফায় বেড়েই চলছে। অপরদিকে কুরবানিকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা সব ধরনের মসলার দাম বৃদ্ধি করেছে। বাজারে ডিমের দাম হাফ সেঞ্চুরি পাড় করেছে। পাড়া-মহল্লার দোকানেও ৫৫ টাকা হালি ডিম বিক্রি হতে দেখা যাচ্ছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৫ টাকা, আর দুই সপ্তাহ ৪০ টাকা হালি ছিল। সবজির বাজারে আরো করুণ অবস্থা। বাজারে ৬০ টাকার কমে কোন সবজি নেই। পেঁপের দামও আকাশচুম্বী। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে এখনও চড়া মাছের দাম। বাজারে অধিকাংশ মাছের দাম তেমন একটা কমেনি। এদিকে, আগের মতোই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের সবজি।
নিত্যপণ্যের বাজারে অবস্থা নিয়ে গতকাল ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে মাদরাসা ময়দানে বলেছিলেন, আমি কী চাই? পাঁচবার বলেছিলেন, আমি কী চাই? সামগ্রিকভাবে একটি কথাই বলেছিলেন। বাংলার মানুষ খেতে পারবে, পরতে পারবে, মুক্ত হাওয়ায় বসবাস করবে, প্রাণ খুলে হাসতে পারবে। আমি কি হাসতে পারি এখন! বাজারে গেলে বাজার করতে পারি না কেন? আমিতো মোটামুটি মধ্যবিত্ত, সামাজিক পরিচিতি আমার আছে। আমি ওষুধ কিনতে পারি না কেন? ওষুধের দাম কত ভাগ বেড়েছে? বাড়বেই?
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা যায়, সবজির বাজারে অধিকাংশ সবজির দাম আকাশচুম্বী। বাজারে টমেটো ৭০ টাকা, দেশি গাজর ১০০, লম্বা বেগুন ৮০, সাদা গোল বেগুন ৮০, কালো গোল বেগুন ৯০, শসা ৫০ থেকে ৭০, উচ্ছে ৬০, করলা ৬০, কাঁকরোল ৯০ থেকে ১০০, পেঁপে ৭০ থেকে ১০০, মুলা ৬০, ঢ্যাঁড়স ৬০, পটল ৬০ থেকে ১০০, চিচিঙ্গা ৬০ থেকে ৮০, ধুন্দল ৬০ থেকে ৮০, ঝিঙা ৬০ থেকে ৮০, বরবটি ৮০, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০, কচুরমুখী ১৪০, শজনে ১৬০, কাঁচা মরিচ ১৬০ ও ধনেপাতা ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মানভেদে প্রতিটি লাউ ৭০ টাকা ও চালকুমড়া ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি হালি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা করে। গত সপ্তাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, প্রায় সব সবজির দামই কমেছে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ২০ টাকা করে দাম বেড়েছে টমেটো ও শজনের দাম।
এদিকে বাজারে মানভেদে ক্রস জাতের পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা, লাল ও সাদা আলু ৫৫ টাকা, বগুড়ার আলু ৭০ টাকা, নতুন দেশি রসুন ২২০ টাকা, চায়না রসুন ২২০ টাকা, চায়না আদা ২৪০ টাকা, ভারতীয় ২৬০ দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতি সপ্তাহের ব্যবধানেই দেশি রসুনের দাম বাড়ছে ২০ টাকা করে। আর আলুর দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫ টাকা করে। এ ছাড়া গতকাল বাজারে ইলিশ ওজন অনুযায়ী ১৮০০ থেকে ২৪০০ টাকা, রুই ৩৬০ থেকে ৫০০, কাতল ৪৫০ থেকে ৬৫০, কালিবাউশ ৪০০, চিংড়ি ১০০০ থেকে ১৪০০, কাঁচকি ৬০০, কই ২৬০ থেকে ৫০০, পাবদা ৪০০ থেকে ৫০০, শিং ৪০০ থেকে ১০০০, টেংরা ৫৫০ থেকে ৮০০, বেলে ৬০০ থেকে ১২০০, বোয়াল ৭০০ থেকে ১০০০ ও রূপচাঁদা ৬০০ থেকে ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে সব ধরনের মুরগি কিছুটা কমলেও এখনো দাম নাগালের বাইরে। ওজন অনুযায়ী ব্রয়লার মুরগি ২০৫ থেকে ২১৫ টাকা, কক মুরগি ৩৩০ থেকে ৩৪০, লেয়ার মুরগি ৩৩৫ থেকে ৩৪০, দেশি মুরগি ৬৫০, গরুর গোশত ৭৮০ ও খাসির গোশত ১১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর মুরগির লাল ডিম ১৪৫-১৫০ টাকা এবং সাদা ডিম ১৪০ টাকা প্রতি ডজন বিক্রি হচ্ছে। পাড়া মহল্লায় ৫৫ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলেও মুদি দোকানের পণ্যের দাম রয়েছে অপরিবর্তিত। প্যাকেট পোলাওর চাল ১৫৫ টাকা, খোলা পোলাওর চাল মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০, ছোট মসুর ডাল ১৪০, মোটা মসুর ডাল ১১০, বড় মুগডাল ১৬০, ছোট মুগডাল ১৯০, খেসারি ডাল ১২০, বুটের ডাল ১১৫, ডাবলি ৮০ ও ছোলা ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪৭, কৌটাজাত ঘি ১৩৫০, খোলা ঘি ১২৫০, প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫, খোলা চিনি ১৩৫, দুই কেজি প্যাকেট ময়দা ১৫০, আটা দুই কেজির প্যাকেট ১৩০ ও খোলা সরিষার তেল প্রতি লিটার ১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে কুরবানীকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা সব ধরনের মসলার দাম বাড়িয়েছে। কোরবানির ঈদে মসলার চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানির বেশ আগেভাগেই সব ধরনের মসলার দাম বাড়তি। কোরবানির ঈদের বাকি আরও প্রায় দেড় মাস। এর মধ্যেই মসলার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে এলাচির দাম বাড়ছে লাফিয়ে। এ ছাড়া অন্যান্য মসলার মধ্যে দারুচিনি, লবঙ্গ, ধনে, তেজপাতা, শুকনা মরিচ ও হলুদের দামও গত বছরের তুলনায় বাড়তি। কোরবানির ঈদে মসলার চাহিদা বছরের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি থাকে। তাই কোরবানিকে সামনে রেখে আগেভাগেই বাজারে মসলার দাম বেড়ে গেছে।
মসলার পাইকারি ও খুচরা জানান, দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে এলাচির দাম। দুই মাস আগে প্রতি কেজি এলাচির দাম ছিল ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা। খুচরায় এখন তা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। তবে গত বছরের তুলনায় এলাচির দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। এলাচির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে আমদানিকারকেরা বলছেন, বিদেশে এলাচির দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচও বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, আমদানি করা এলাচি কয়েক হাত বদলের পর খুচরায় এসে দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমদানিকারক থেকে নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী এলাচি মজুত করে বেশি মুনাফা করছেন। আমদানিকারকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমদানি করা সব ধরনের মসলার দাম। তবে বাজার অস্থিতিশীল বলা যাবে না। আমদানি অব্যাহত আছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত সপ্তাহের তালিকানুযায়ী, ছোট আকারের এলাচির খুচরা দাম কেজি প্রতি ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এক বছর আগে (গত কোরবানির ঈদ বাজারে) ছিল ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বাজারে এলাচির দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ। বাজারে বড় আকারের এলাচির দাম আরেকটু বেশি। খুচরা বাজারে বড় আকারের প্রতি কেজি এলাচি সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে।
অন্য মসলার মধ্যে টিসিবির তালিকা অনুযায়ী, বাজারে প্রতি কেজি দারুচিনির দাম এখন ৫০০-৫৮০ টাকা। এক বছর আগে যা ছিল ৪৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ। বর্তমানে লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। গত বছরের এই সময়ে ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে লবঙ্গের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ। বাজারে ধনের কেজি এখন ২০০ থেকে ২৪০ টাকা। এক বছর আগে ছিল ১৩০-১৬০ টাকা। সেই হিসাবে ধনের দাম এক বছরে বেড়েছে ৫২ শতাংশ। প্রতি কেজি তেজপাতার দাম এখন ১৫০-২০০ টাকা। গত বছরের তুলনায় যা ২৫ শতাংশ বেশি।
টিসিবির বাজারদরের তালিকা অনুযায়ী, প্রতি কেজি জিরার দাম এখন বাজারে সর্বোচ্চ ৮৫০ টাকা। গত বছরে একই সময়ে যা ছিল সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, জিরার দাম ছয় মাস আগে আরও বেশি ছিল। তখন প্রতি কেজি জিরার দাম হাজার টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছুটা কমেছে। তবে বছর দুয়েক আগেও ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি জিরার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেই পরিস্থিতিতে ফেরার মতো অবস্থা এখনো হয়নি বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। দিকে বাজারে হলুদ ও শুকনা মরিচের মতো পণ্যের দামও গত বছরের তুলনায় বাড়তি।
টিসিবির হিসাবে, বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪৪০-৫০০ টাকায়। গত বছর এই সময়ে দাম ছিল ৪২০-৪৬০ টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। আর আমদানি করা হলুদের দাম গত বছর ছিল প্রতি কেজি ১৯০-১৩০ টাকা। এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৮০-৩৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।