দেশে ফের ডেঙ্গু নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে। ধীরে ধীরে এর প্রকোপ বাড়ছে। চলতি বছর সাড়ে ৫ মাসেই পাওয়া গেছে গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ ডেঙ্গু রোগী। মৃত্যুও প্রায় তিনগুণ। প্রাণহানির ট্রেন্ডে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি রয়েছেন। রাজধানীর তুলনায় ঢাকার বাইরে রোগী বেশি শনাক্ত হচ্ছে। এডিস মশাবাহিত এই রোগ গত বছরের চেয়েও ভয়ঙ্কররূপে ফেরার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় রোগীর ভোগান্তি এড়াতে আগাম প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। রোগী বেড়ে গেলে শিরায় দেয়া স্যালাইনের যাতে সংকট না দেখা দেয়, সে জন্য আগে থেকেই মজুত রাখতে বলা হয়েছে হাসপাতালগুলোকে। এ ছাড়া রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে ওষুধ ও প্লাজমা আমদানির চিন্তা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর ১৭ই মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ১২ জনের।
চলতি বছরের একই তারিখ পর্যন্ত প্রাণহানি হয়েছে ৩৩ জনের। যা গত বছরের একই সময়ে মৃত্যুর প্রায় তিনগুণ। এ ছাড়া এ বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। গত বছর উল্লিখিত তারিখ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ১ হাজার ৩৩০ জন। এবার ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৫৮১ জন।
দেশে রেকর্ড সংখ্যক ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। রোগী হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় জুলাই-আগস্টের দিকে কোথাও কোথাও স্যালাইন সংকট দেখা দেয়। যেসব জায়গায় স্যালাইন পাওয়া গেছে, চার থেকে পাঁচ গুণ টাকা গুনতে হয়েছে। সাধারণত এসব স্যালাইনের দাম ১০০ টাকার কম। এ বছর যাতে ফের এমন পরিস্থিতির উদ্ভব না হয়, সে জন্য ইতিমধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, কৃত্রিম সংকট মোকাবিলা করতে চাহিদার চেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন। এ কারণে উৎপাদন বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব হাসপাতালে এখন থেকে স্যালাইন কিনে মজুত রাখতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ) চিকিৎসার জন্য প্লাজমা ও রক্তক্ষরণ প্রতিরোধী ওষুধ আমদানি করা যায় কিনা, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। মার্চ থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। এসময়ে সারা দেশে প্রতি মাসে স্যালাইনের চাহিদা থাকে প্রায় ৫০ লাখ লিটার। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে না। এই সময়ে এ ধরনের স্যালাইনের মাসিক চাহিদা থাকে প্রায় ৩০ লাখ লিটার।
চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হতে পারে- এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এবছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে দেখা যায়, গতবারের তুলনায় এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুর দুই সূচকই দ্বিগুণের বেশি। এতে ধারণা করা যায়, এবার গতবারের চেয়েও ভয়ঙ্কররূপে ফিরবে ডেঙ্গু। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশি খারাপ হবে। রোগটি প্রতিরোধে ঢাকায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও ঢাকার বাইরে তো কিছুই করা হয় না। তাই সেদিকে নজর দেয়া জরুরি।
এদিকে, গত ৭ই মে ২০২৪ সালের ডেঙ্গু নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল ডেঙ্গুতে নিজের মাকে হারিয়েছেন জানিয়ে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে আমার চিন্তা আছে। আমি কাজ করবো, যাতে আর কারো মা এতে মারা না যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সব রোগের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে যাতে রোগটি কারও হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করা যায়। যাতে মানুষের ডেঙ্গু না হয়। সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। মশা নির্মূলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন এবং যে ঘরে মানুষ থাকে সেখানকার সবাইকেই সচেতন থাকতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা অনেক আলোচনা ইতিমধ্যে করেছি। আমি নির্দেশনা দিয়েছি যাতে ডেঙ্গুকালীন কোনোভাবেই স্যালাইন সংকট দেখা না দেয় এবং স্যালাইনের দামও না বাড়ে। এ ছাড়া হাসপাতালগুলোকে খালি রাখার ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দিয়েছি। যাতে করে পরে সার্জারি বা ভর্তি না করে চিকিৎসা দেয়া যায় এমন যারা আছে তাদের হাসপাতালে ভর্তি না করে যাদের প্রয়োজন তাদের ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া আমাদের ফগিং বিষয়ে কিছু ভুল ধারণা আছে। এ বিষয়ে আলোচনা করবো। সিটি করপোরেশনের সঙ্গেও ওপেনলি আলোচনা করবো।
৩৩ জনের মৃত্যু, ২৫৮১ রোগী ভর্তি: দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১২ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এনিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এবছর ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৮১ জনে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এরমধ্যে নারী ১৯ জন এবং পুরুষ ১৪ জন। মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাজধানীতে ২১ জন এবং ঢাকার বাইরে বরিশালে ৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২ জনের প্রাণহানি হয়েছে ডেঙ্গুতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ১২ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫ জনে। চলতি বছরের এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২ হাজার ৪১৩ জন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ ১ হাজার ৫৫৫ জন এবং নারী ১ হাজার ২৬ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে ঢাকা মহানগরে ৮৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ৬৯৬ জন রয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৩৫৫ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৫৫ জন, খুলনা বিভাগে ১১৬ জন, রাজশাহী ৪৭ জন, রংপুর বিভাগে ১৭ জন, বরিশাল বিভাগে ৩৪১ জন এবং সিলেট বিভাগে ১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ জন এবং মারা গেছেন ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩১১ জন এবং মারা গেছেন ৫ জন, এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০৪ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসের ১৭ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭২ জন এবং মারা গেছেন ৯ জন।