রাষ্ট্রের অনিবার্য উপাদান সরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র হয়ে ওঠার যেসব শর্তাবলি আছে তার মধ্যে সরকার অন্যতম। একটি অঞ্চলে জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং স্বাধীন সরকার না থাকলে রাষ্ট্র হবে না। ধরে নিন ভারতের তামিলনাড়ু। সেখানে জনসংখ্যা আছে, সীমারেখা চিহ্নিত একটি ভূখণ্ড আছে এবং একটি রাজ্যসরকার বা প্রাদেশিক পরিষদ আছে। সেটি রাষ্ট্র নয়। ভারতের অঙ্গরাজ্য মাত্র। তার কারণ, সেখানে রাষ্ট্রের একটি অনিবার্য উপাদান অনুপস্থিত। আর সেটি হচ্ছে- সার্বভৌমত্ব। সার্বভৌমত্ব অর্থ অন্য থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে, কোনো রকম প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যতিরেকে নিজের দেশ পরিচালনা। এক কথায়, সার্বভৌমত্বকে বলা যায় রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা। সার্বভৌমত্ব দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। আর সে সার্বভৌমত্বের প্রয়োগকর্তা সরকার। সরকার মানে রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনা। তাদের যেটি নেই সেটি হচ্ছে- সার্বিক ক্ষমতা। তারা ইচ্ছা করলেই অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা করতে পারে না। চূড়ান্ত অর্থে রাজ্যে কোনো বিশৃঙ্খলা বা অসাংবিধানিক অবস্থা বিরাজ করলে কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে। সব কথার শেষ কথা, ওই ভূখণ্ডের ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মালিক কেন্দ্রীয় সরকার- দিল্লি।
এখন যদি কোনো রাষ্ট্র, যার ভূখণ্ড আছে, জনসংখ্যা আছে এবং একটি সরকারও আছে অথচ এরা নিজেদের কাজকর্ম স্বাধীনভাবে করতে পারে না; সব ক্ষেত্রেই অন্যের আদেশ-উপদেশ শিরোধার্য করতে হয়, নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নিজেরা পরিচালনা করতে পারে না, তাহলে আপনি কি সেই দেশ বা ভূখণ্ডকে স্বাধীন বলবেন? সেই সরকার কি প্রক্সি সরকার নয়? পৃথিবীতে এ রকম কিছু রাষ্ট্র আছে। রাষ্ট্রের সব উপাদানই আছে; কিন্তু নিজেকে নিজে চালানোর ক্ষমতা নেই। সেটি রাষ্ট্র হিসেবে কিভাবে দাবি করতে পারে? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এসব রাষ্ট্রকে বলেন Failed State বা ব্যর্থ রাষ্ট্র। উইকিপিডিয়ায় এই Failed State-এর একটি তত্ত্ব আছে। সেটি এ রকম : ‘A failed state is a state that has lost its ability to fulfill fundamental security and development functions, lacking effective control over its territory and borders. Common characteristics of a failed state include a government incapable of tax collection, law enforcement, security assurance, territorial control, political or civil office staffing, and infrastructure maintenance. When this happens, widespread corruption and criminality, the intervention of state and non-state actors, the appearance of refugees and the involuntary movement of populations, sharp economic decline, and military intervention from both within and outside the state are much more likely to occur’.
বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় আছে তাতে সবকিছুই ব্যর্থ এমন নয়। তবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রবণতাগুলো স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশ তার নাগরিকদের মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সীমান্তে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। দেশের মানুষ বারবার সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের অসংখ্য বৈঠক লক্ষ করেছে। প্রতিবারই বলা হয়েছে, আর গুলিবর্ষণ হবে না। দেখা গেছে, বৈঠকের পরদিনই বাংলাদেশের মানুষ নিহত হয়েছে।
অপর সীমান্তে চোখ বোলানো যাক। সেখান থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের আশ্রয় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। মানবিকতার সে মহত্ত্ব সরকার দাবি করতে পারে। কিন্তু সার্বভৌম সরকার হিসেবে খুব কঠিন ভাষায় রোহিঙ্গা বিতাড়নের প্রতিবাদ করতে দেখিনি। একটি যুদ্ধের ভীতি দেখানো তো দূরের কথা, বাংলাদেশকে ফোঁস করতেও দেখিনি। কূটনীতিতে অনেক অকথিত কথা থাকে। তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করিনি; বরং সরকারের শীর্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের দেখেছি অধীনতামূলক মিত্রতার ভাষায় কথা বলতে। এরূপ বৈরিতার মধ্যেও বাংলাদেশের মন্ত্রী গেছেন সেখানে চাল কিনতে। এমনকি তাদের দুই বিপরীত মেরুর মিত্র ভারত ও চীনকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। জাতিসঙ্ঘে প্রায়ই ভারত বরং ভোট দানে বিরত থেকেছে। চীন কখনো কখনো একটু আধটু উঁকিঝুঁকি মেরেছে। মিয়ানমার সরকার একবার নয়, বেশ কয়েকবার সীমান্তে হামলা করেছে। প্রতিবারই তারা বলেছে, ভুল হয়েছে। সর্বশেষ ঘটনায় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সীমান্তে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গোলা এসে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করেছে। অনেক মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। কিন্তু সীমান্ত লঙ্ঘনের প্রতিবাদটুকুও উচ্চারিত হয়নি। নাগরিকদের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদানের মৌলিক কর্তব্য পালনও যদি সরকার করতে না পারে তাহলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের লকব কি অনিবার্য হয়ে ওঠে না?
আর মহাভারতের কথা তো এখন আর আমাদের কাছে অমৃত সমান নয়; বরং সকলই গরল ভেল। ভারতের সাথে সীমান্ত রয়েছে আরো অনেক রাষ্ট্রের। চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান। কখনো কি এসব সীমান্তে কোনো গুলিবর্ষণের কথা শুনেছেন? তারা পাখির মতো মানুষ মারছে বাংলাদেশ সীমান্তে। ফেলানীর লাশ আজো ঝুলে আছে মানুষের মানসপটে। তার কোনো বিচার হয়নি। বাংলাদেশের সীমান্তে তারা কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ভারতে পা রাখলে গুলি করছে। তারপরও তারা আমাদের বন্ধু!
একবার একজন সাহসী জেনারেল ফজলুর রহমান বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় অনুপ্রবেশের প্রতিবাদ করেছিলেন। তাকে আমরা পুরস্কৃৃত না করে তিরস্কৃত করেছি। ভদ্রলোক চাকরি হারিয়েছিলেন এই দেশপ্রেমের কারণে। সেটি অবশ্য এই সরকারের আমলের কথা নয়। বলতে হয় কী বিচিত্র এই দেশ! যেখানে বাংলাদেশের সরকারের তীব্র প্রতিবাদ করার কথা, সেখানে তারা তেলিয়ে কথা বলেছে। মনে পড়ে শাসকদলের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী এত দীর্ঘ সীমান্তে এ ধরনের ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করেছেন। আরেকজন মন্ত্রী বলেছেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পৃথিবীর কোনো সীমান্তে এ রকম অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা কেউ কি দেখাতে পারবেন? তাহলে কি বলা যাবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আবছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে কথিত মিত্রতার ছায়ায়?
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা ও স্বীকৃতি আমাদের জন্য অশেষ ঋণের কারণ। শেখ মুজিব তাদের বেরুবাড়ি ফেরত দিয়েছেন। আমাদের ভূমিতে জেগে ওঠা তালপট্টি নিয়ে তারা তামাশা করেছে। অবশেষে এই আমলের শুরুতে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। জিয়াউর রহমান সরকারকে বিব্রত করার জন্য শান্তিবাহিনীর মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি করার যে পাঁয়তারা করেছিল, এই আমলে শান্তিচুক্তির নামে সরকারিভাবে তার সমাধান হয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ণয়ে বন্ধুত্ব নয়, আন্তর্জাতিক আদালতে তা মীমাংসিত হয়েছে। ভারতের ‘সপ্তকন্যায়’ বিরাজিত চির বিদ্রোহ দমনে এই সরকার সম্পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছে। মানবিকতাকে অগ্রাহ্য করে অনুপচেটিয়াদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারতের কৌশলগত চাওয়া ট্রানজিট ভারতকে বিনা শর্তে ও বিনা শুল্কে অবারিতভাবে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে ভারতের অনুরোধ এখন অবকাঠামো পর্যায়ে অতিক্রম করছে। ভারতের প্রার্থিত নৌ-ট্রানজিট ও বন্দর সুবিধা দেয়া হয়েছে। ফেনী নদীর পানিও দিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বহুল আকাক্সিক্ষত তিস্তা নদীর পানি আমরা পাইনি। প্রধানমন্ত্রী একবার তুষ্টির সাথে বলেছিলেন- আমরা সবকিছু দিয়েছি। কিন্তু তার বিনিময়ে আমরা কী পেয়েছি, সাধারণ মানুষ তা ভালো করে জানে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আজকাল দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন, ভারতের প্রযতœ ব্যতীত বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি নেই। ভারতের মিত্রই আমাদের মিত্র। ভারতের শত্রুই আমাদের শত্রু। তারা সার্কের উদাহরণ তুলে ধরছেন। ২০০৯ সাল থেকে কিভাবে বাংলাদেশের সৃষ্ট দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা-সার্ককে অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট। ভারতের কূটনীতিবিদরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশকে নসিহত করেছেন সার্ককে কার্যকর না করার জন্য। বিপরীতে ভারতের স্বার্থে ‘ব্রিকস’ সহযোগিতা সংস্থাকে জোরদার করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় যেকোনো সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে অবাধ সহযোগিতা ছাড়পত্র দিতে রাজি। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অবাধ স্বাধীনতা দিতে রাজি নয় ভারত। কুশলী কূটনীতিসুলভ নীরবতা অবশেষে বিগত নির্বাচনে ভারত প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবস্থাদি নিতে নিবৃত্ত করেছে- এটি এখন স্পষ্ট। সেই এক-এগারো থেকে তাদের যে হস্তক্ষেপের সূচনা তা এখন ফুলে-ফলে বিষবৃক্ষ আকার ধারণ করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে যে নগ্ন নাটকের অভিনয় করেছিলেন তা এখনো নাগরিকদের স্মৃতিপটে জাগরূক রয়েছে। ২০১৮ সালেও তাদের অনুরূপ ভূমিকা ছিল। ২০২৪ সালে তা আবারো প্রকটভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শাসকদলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি প্রকাশ্যে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে লজ্জা-শরমের বালাই রাখেননি। এর আগের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেফাঁসে ফাঁস করে দিয়েছিলেন যে, তিনি আগামী পাঁচ বছরের জন্য শেখ হাসিনার গদি পাকাপোক্ত করার অনুরোধ করে এসেছেন। এভাবে ভারতের দীর্ঘ হস্তক্ষেপের ইতিহাস পর্যালোচনা করে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়, বাংলাদেশ কি শাসিত হয় ঢাকা থেকে? জনসাধারণে এই ধারণা ক্রমেই বদ্ধমূল হচ্ছে যে, দেশটি এখন আর আমাদের হাতে নেই। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে ‘সার্বিয়া সিনড্রোম’ লক্ষ করা যায়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতো বিদ্বজ্জনরা যখন বলেন, ‘সার্বিকভাবে বিগত সময়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সার্বভৌমত্ব চলে গেছে’। (প্রথম আলো, ১২ মে, ২০২৪) তখন অবশ্যই একে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নয়, এক অদৃশ্য শক্তি দেশ চালাচ্ছে।’ এগুলোকে নিছক রাজনৈতিক বলে নাকচ করা যায় কি!
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com