প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে বাংলাদেশের রক্ষাকবচ সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ এ বনে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বিগ্ন সবাই। ৪ মে পূর্ব সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। ৬ মে দুপুরে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার, কোস্ট গার্ড ও বন বিভাগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ৪ মে আগুন লাগার খবর প্রকাশ হলেও প্রকৃতপক্ষে আগুন লাগার প্রমাণ পাওয়া গেছে আরও কমপক্ষে চারদিন আগে। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সুন্দরবনে আগুন লাগার ছবি ধারণ করেছে। সেখানে ৩০ এপ্রিলের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, প্রায় ১.৬ হেক্টর এলাকা ইতোমধ্যে আগুন লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ১০ মের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, সুন্দরবনের প্রায় ৬.৯ হেক্টর এলাকায় আগুন লেগেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) সদস্য ড. মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন পত্রিকায় সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ৪ মে আগুন লেগেছিল এবং সেটি ৩-৪ দিন থাকে। তখন আমরা চেষ্টা করছিলাম আগুনের ঘটনাটি স্যাটেলাইট ইমেজে দেখার। ফ্রি ডেটা সেন্টিনেল-২ (Sentinel-2) এবং ল্যান্ডস্যাট (Landsat) দিয়ে আমরা চেষ্টা করছিলাম। পরবর্তী সময়ে সেন্টিনেল-২ থেকে ২৪ ও ৩০ এপ্রিল এবং ১০ মের তিনটি ডেটা পাই। পরে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, সুন্দরবনে ৭ হেক্টরের মতো জায়গা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৯-২০২৩ সালের গ্লোবাল ইকোসিস্টেম ডাইনামিক্স ইনভেস্টিগেশন (জিইডিআই) লেজার ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এলাকাটিতে আগুন লাগার আগে গাছপালার গড় উচ্চতা ছিল ২-৩ মিটার। স্যাটেলাইট চিত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এলাকাটি সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১৭৫ মিটার (ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কেন্দ্রটি সীমানা থেকে ৩১০ মিটার) ভেতরে অবস্থিত।
ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা ধারণা করতে পারি, ২৪-৩০ এপ্রিলের মধ্যে সুন্দরবনের ওই এলাকায় সীমিত আকারে আগুন লাগার সূত্রপাত হয়েছে এবং এতে প্রায় ১.৬ হেক্টর এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে ৩-৪ মে বৃহত্তর পরিসরে আগুন লাগে, যা আরও ৫.৩ হেক্টর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে পূর্ব সুন্দরবনের আগুন লাগার কারণ জানতে ৪ মে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি এখনো কাজ করছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম যুগান্তরকে বলেন, কমিটির কাজ চলমান আছে। প্রতিবেদন পেতে আরও সময় লাগবে। ৪ মে আগুন লাগার খবর আসে। আপনারা আগুন কখন লেগেছে বলে জানতে পারেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম যুগান্তরকে বলেন, আমরা ৪ তারিখেই জানতে পেরেছি।
প্রসঙ্গত, সুন্দরবনে এর আগেও অনেকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনগুলোয় বারবার মৌয়াল, বাওয়াল, জেলেদের দ্বারা বিড়ি-সিগারেটের আগুন, মৌমাছি তাড়াতে মশালের আগুন থেকে এর সূত্রপাতের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মো. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বন বিভাগ বলছে ওখানে বড় ধরনের কোনো গাছ ছিল না। তারা কতটুকু ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেবে, আমার জানা নেই। দুই বছর আগেও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। পূর্ব সুন্দরবনেই ঘটছে বারবার। আমাদেরকে পরিবেশের দিক থেকে ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে এখন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বন বিভাগের অদক্ষতা এবং অবহেলার কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বারবার। পাহাড়ি বনে আগুন দেওয়া হয় সাধারণত শত্রুতা থেকে। এখানে সেরকম বিষয় নেই। আগুন কেউ না কেউ তো ধরিয়েছে। মৌয়াল বা বাওয়ালদের যখন মধু সংগ্রহ বা গাছ কাটার জন্য পাশ দেওয়া হবে, তখন তাদের অবশ্যই সচেতন করতে হবে। এপ্রিল-মে মধু আহরণের সময়। সাম্প্রতিক সময়ে তারা গিয়েছে বলেও জানি। আগুন মূলত অসচেতনতার কারণেই হয় বলে মনে করি। বন বিভাগের যে লোকবল ও দক্ষতা, এর কেনোটাই মনে হয় না যথেষ্ট পরিমাণে আছে।
তিনি বলেন, বন বিভাগ মূলত প্রজেক্টনির্ভর একটি ডিপার্টমেন্ট। প্রজেক্ট এলো তো কিছু কাজ হলো। প্রজেক্টের টাকা এখানে সব সময় হরিলুট হয়।
এদিকে সুন্দরবনে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত জীববৈচিত্র্যের পরিমাণ নির্ণয়ে ৭ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়েছে। এ দলের অন্যতম সদস্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. এসএম ফিরোজ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সুন্দরবনে আগুনের ঘটনায় জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং এ বিষয়ে প্রতিকার কীভাবে হতে পারে, এর জন্য একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে কাজটি করছি। আগুন লাগার কয়েকদিন পর আমরা সেখানকার মাটি, গাছের স্যাম্পল, প্রাণীর স্যাম্পল সংগ্রহ করেছি। পোড়া এবং পোড়েনি-এমন এলাকর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে এসেছি। সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে। পরে আমরা একটি প্রতিবেদন দেব।