দেশের ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, সাংবাদিক সবার দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত টক অব দ্য কান্ট্রি। কী হচ্ছে সেখানে। অনেক দিন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ি (অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা) চলছে। এমনিতেই দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা হারাচ্ছেন গ্রাহকরা। অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের কাছে রাখছেন। এর মধ্যে গত ৭ মে অর্থনীতিবিষয়ক রিপোর্টারদের সংগঠন ইআরএফ আয়োজিত অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকে কিছু একটা গণ্ডগোল চলছে।’ অতঃপর ভারত থেকে প্রকাশিত নর্থ ইস্ট নিউজের এক খবরে বলা হয়, ভারতীয় কিছু হ্যাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক বিলিয়ন ডলার চুরি করে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে দুই দেশের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা নীরবে তদন্ত চালাচ্ছেন।’ এমন পরিস্থিতির মুখে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিবৃতিতে রিজার্ভ চুরিসংক্রান্ত প্রতিবেদনের সত্যতা নাকচ করে দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক ফেডের সঙ্গে লেনদেনে নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বর্তমানে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নীতি চালু রয়েছে। এর ফলে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা ভুয়া (ফেক)। ভারতের গণমাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ চুরির খবর বাংলাদেশ ব্যাংক অস্বীকার করলেও গুজব বন্ধ হয়নি। এর মধ্যে গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশ ব্যাংকে যান। সেখানে তিনি গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদার বৈঠক করেন। একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসব ঘটনা এবং সদর দফতরে সাংবাদিকদের প্রবেশে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা; অন্যদিকে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হ্যাকারদের বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় ৩৯ দিন ওই ভয়াবহ চুরির ঘটনা লুকিয়ে রেখে সে সময়ের গভর্নর ড. আতিউর রহমান দিল্লি যান একটি সেমিনারে অংশ নিতে। তখন ফিলিপাইনের একটি গণমাধ্যম বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ভয়াবহ চুরির খবর প্রকাশ করে। প্রথমে লুকাচাপার চেষ্টা করলেও পরে চুরির ঘটনা স্বীকার করে। এমন এক সময়ে এই খবর এসেছে যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। ডলারের দাম বাড়ানোয় নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে গুজব এবং গোপনীয়তা ব্যাংকিং সেক্টরকে অবিশ্বাসের গহ্বরে ফেলে দেবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ টিম গঠন করা যেতে পারে। তারাই সবকিছু স্বচ্ছতার সঙ্গে দেখভাল করবে এবং প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে সৃষ্ট গুজবের নিরসন করবেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক খাতের প্রধান ও একমাত্র সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব। এর অভাবেই ব্যাংক খাতে যত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আজকে যে তারল্য সংকট, গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারা, ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করে দেওয়া, মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি, আয় কমে যাওয়াÑ এ সবই হয়েছে সুশাসনের অভাব থেকে। সুশাসন থাকলে এত কিছু হতো না। জালজালিয়াতি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনা ধরা পড়ে যেত এবং সুশাসনের কারণে জড়িতদের বিচার হতো। দ্বিতীয় দফায় এমন ঘটনা আর ঘটত না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। যে কারণে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এভাবে ব্যাংক খাতের মতো স্পর্শকাতর একটি সেক্টর চলতে পারে না।
ভারতীয় গণমাধ্যমে টাকা চুরির খবর প্রকাশের পর অনেকেই ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারিতে ডেপুটি গভর্নরের পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর ওই দিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং রিফর্ম’ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা সিতাংশু কুমার চৌধুরীর (এস কে সুর) যোগসূত্র খুঁজছেন মানুষ। কারণ ২০১৬ সালে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির সময় ব্যাংকের কম্পিউটারের বিশেষ ডিভাইস দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন এস কে সুর। তার সময় দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তিনি নিজের অনুগত লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে আলোচিত এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন ও সুবিধা নিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, বিভিন্ন সময় অনিয়মের অনুসন্ধান এবং তদন্তের জন্য এস কে সুর চৌধুরী ও তার স্ত্রী সুপর্ণা সুর চৌধুরীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করেছিল দুদক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর ফাঁকির দায়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করারও নির্দেশনা দেয় এনবিআর।
দীর্ঘ প্রায় ২ বছর ধরে ডলার সঙ্কট, নিয়ন্ত্রিত আমদানির পরও রফতানি আয়ে হতাশা, সর্বশেষ এপ্রিল মাসে লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রবৃদ্ধি দুই অবস্থানেও পিছিয়ে। প্রণোদনাসহ নানামুখী সুবিধার পরও বাড়ছে না রেমিট্যান্স। এমনকি ঈদের মাস এপ্রিলেও কমেছে রেমিট্যান্স। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমায় তাই কমেছে রিজার্ভ। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। বর্তমানে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। এর আগে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়ানোর পর এর নিচে কখনো নামেনি। এছাড়া রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতিতে রয়েছে। এদিকে আর্থিক খাতের হৃদপিন্ড বলা হয় ব্যাংক খাতকে। দীর্ঘদিন থেকেই খেলাপি ঋণসহ একটি মাফিয়া চক্রের কাছে ব্যাংকগুলোর মালিকানা চলে যাওয়ায় এই খাত বিপাকে। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোর করে চাপিয়ে দেয়া একীভূতকরণ বা মার্জার। আর তাই দেশের আর্থিক খাতের দৈন্যদশার সঙ্গে আলোচনায় আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। করোনার সময় প্রণোদনা প্যাকেজকে অর্থনীতির রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলকে বুঝিয়ে গভর্নর পদে বসেন তিনি। অথচ এই প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা এখনও ব্যাংকগুলো ফেরত পায়নি। এ কারণেও ধুঁকছে ব্যাংকিং খাত। আদৌ এই টাকা পাবে কি না এ নিয়ে সন্দেহ ব্যাংকগুলোর। এরপর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভুল নীতি, ডলারের বিনিময় হার, ঋণের সুদহার, জোর করে চাপিয়ে দেয়া মার্জারের সিদ্ধান্তসহ সকল সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণ করেছে। আর তাই শেষে বাধ্য হয়ে আর্থিক খাতের দৈন্যদশার তথ্য যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আনেন। কিন্তু এতে সংকট বেড়েছে আরও। ভারতের গণমাধ্যম সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ আবারও হ্যাক হয়েছে। নর্থইস্ট নিউজ নামের এই সংবাদ মাধ্যমের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ হ্যাক করে নিয়ে গেছে ভারতীয় হ্যাকাররা। যদিও এ খবর সত্য নয় বলেই দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের হ্যাকিংয়ের অর্থ ফেরত আনা জড়িতদের এখনও চিহ্নিত বা শাস্তির আওয়াতায় আনতে না পারলেও নতুন করে রিজার্ভ হ্যাকের বিষয়টিকে ‘গুজব’ আখ্যা দিয়ে একটি বিৃবতি দিয়েই সেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশ্য রিজার্ভ হ্যাকিং নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা চলছে তাহলে কি আবারও ২০১৬ সালের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কি না। কারণ ওই সময়ে ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে হ্যাকাররা ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান ওই সময়ে ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর পরামর্শে এক মাসের বেশি এ তথ্য গোপন রাখেন। পরে ফিলিপাইনসহ বিদেশের একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা জানাজানি হয়। এ সময় গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগে বাধ্য হন। দু’জন ডেপুটি গভর্নরের চুক্তি বাতিল করে সরকার। যদিও এ ঘটনার নাটের গুরু এস কে সুর দুই মেয়াদে ডেপুটি গভর্নর এবং পরবর্তীতে চুক্তিভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর এই সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে চালিয়েছেন। একটি বিতর্কিত শিল্প গ্রুপের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ব্যাংকে তৈরি করেন নিজস্ব বলয়। ওই চক্রটি এখন বিভিন্ন ব্যাংকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে নানা অনিয়মে রয়েছে ওই সিন্ডিকেটের কর্তৃত্ব। এস কে সুরের ছত্রছায়ায় ভারতে আটক প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদারের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাত ও পাচারের পর দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করারও অভিযোগ রয়েছে। আর গত কয়েক বছরে পি কে হালদারসহ আর্থিক খাতে নানা অনিয়মে সহযোগিতা করেন এস কে সুর বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণের পর এখনও প্রতি মাসে আমদানি দায় মেটানোর জন্য গড়ে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে প্রকৃত রিজার্ভের অর্থ দিয়ে তিন মাসেরও আমদানি খরচ মেটানো যাবে না।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার জন্য ভালো পরিমাণ রিজার্ভ থাকা জরুরি। এখন রিজার্ভ যে পর্যায়ে নেমে এসেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ আছে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দামের যে পদ্ধতি চালু হয়েছে, তাকে ক্রলিং পেগ বলা হলেও তা ক্রল (ওঠানামা) করছে না। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বিমুখী আচরণ করার সুযোগ শেষ হয়ে এসেছে।