এপ্রিল মাসের শেষ সাপ্তাহে ধান, চাল ও গমের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। ৪৫ টাকা দরে চাল, ৩২ টাকা দরে ধান ও ৩৪ টাকা দরে গমের দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। ঘোষণা দেয়া হয় ৭ মে ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চালু হবে। খাদ্যমন্ত্রী জানান, অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৩২ টাকা দরে ৫ লাখ টন বোরো ধান, ৪৫ টাকা দরে ১১ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও ১ লাখ মেট্রিক টন আতপ চাল একই সঙ্গে ৩৪ টাকা দরে ৫০ হাজার টন গম কেনারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি। সব মিলিয়ে আসন্ন বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। কিন্তু বাজারের অবস্থা কেমন? রাজধানী ঢাকায় ভাতের চাউলের কেজি ৫৫ টাকা থেকে ৮৮ টাকা। অথচ কৃষকদের নতুন ধান বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা মনদরে। এতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। কোনো কৃষক যদি গরুর গোশত খেতে চায় তাহলে এক কেজি গরুর গোশতের জন্য তাকে এক মন ধান বিক্রি করতে হবে।
এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। তবে কষ্টার্জিত সেই ধান বিক্রি করতে গিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন তারা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিমণ ধান উৎপাদনে তাদের খরচ হয়েছে প্রায় ৮০০-১০০০ টাকা। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার কৃষক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘ধান চাষ করে লাভ নেই। সরকার দাম ঠিক করেছে কত, আর বর্তমান বাজারদর কত! আমি এক মণ ধান বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছি, তা দিয়ে এক কেজি গরুর গোশত কিনতে পেরেছি শুধু। এক কেজি গরুর গোশত কিনতে কৃষককে একমন ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কৃষক মো. আনিসুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ১৬ থেকে ১৮ মণ ধান হয়। এক বিঘা জমিতে বীজ, চারা, চাষ, মই, রোপণ, ওষুধ, বিদ্যুৎ বিল, কাটা ও ঘরে তোলাসহ খরচ পড়ে প্রায় ১৬ হাজার টাকা। ৮০০ টাকায় বিক্রি করলে ১৬ মণ ধানের দাম পাওয়া যায় ১২ হাজার ৮০০ টাকা। এতে আমাদের লোকসান হয় প্রায় ৩২০০ টাকা।’
জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আসমা উল হোসনা বলেন, ‘ধানের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৩২ টাকা কেজি। এটা কৃষকদের বলতে হবে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়টি আমরা কৃষকদের বুঝানোর চেষ্টা করছি। যাতে কৃষকরা আমাদের সঙ্গে তালিকাভুক্ত হয়। এতে কৃষকদের উপকার হবে। বাজারে প্রতিমণ ধান ৮০০ টাকায় বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে খোঁজ নেব।’
হাওরসহ দেশের যেসব এলাকায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে সে সব এলাকায় ধানের দাম খুবই কম। স্থানীয় সাংবাদিকরা সরেজমিনে গত মঙ্গলবার ও বুধবার শ্রীপুর ধান বাজারে গিয়ে দেখেন, ধানের বাজারদর কম। তাই কৃষকরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বস্তা ভর্তি ধান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অবশেষে আক্ষেপ নিয়েই কম দামে ধান বিক্রি করে বাড়ি ফিরছেন।
উপজেলার বাওনি গ্রামের কৃষক আবদুল্লাহ বলেন, ‘পাঁচ মণ ধান চার হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। ধানের দাম একেবারে কম। দাম আরও বাড়ানো উচিত। ধানের বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে ধানের দাম কম না বেশি হবে।
একই বাজারে আরেক কৃষক এবাদুল্লাহ জানান, জমিতে থাকাবস্থায় তার ধান এক হাজার টাকা মন বলেছিল ক্রেতারা। কিন্তু তিনি ধান কেটে আরো বেশি দামে বিক্রির আসায় বাজারে এনে ৮শ টাকা মন দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে ধান উৎপাদনে তার কয়েক হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। ভাংনাহাটি গ্রামের মফিজ মিয়া গণমাধ্যমের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আটাশ জাতের ধান বিক্রি করার চেষ্টা করছি। সকালে ব্যাপারী ৯০০ টাকা দর বলেছিল। বিকেল হয়ে গেছে এখনো একই দাম। এমন হলে অন্য বাজারে নিয়ে দেখব দাম বেশি পাই কিনা।’ আবু সাঈদ নামের এক কৃষক বলেন, ৬ বিঘা জমিতে ধান হয়েছে ১০০ মণ। পরিবারের জন্য ৬০ মণ ধান রেখে বাকি ৪০ মণ বাজারে বিক্রি করে দিয়েছি। গত বাজারে বিক্রি করেছি এক হাজার টাকা মণ। এ সপ্তাহে দাম কমে গেছে মণপ্রতি ২০০ টাকা। এখন বাজারে এসে দেখি প্রায় সব ধান বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায় এবং ভালো মানেরটা ৯০০ টাকায়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গাজীপুরের সহকারী পরিচালক শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘ধানের দাম উঠানামার বিষয়গুলো আমরা দেখি না।’
শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম কম। এজন্য সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধানের দাম পেতে আমরা উপসহকারী কৃষি অফিসারের মাধ্যমে কৃষকদের অবহিত করছি, যাতে তারা অ্যাপে আবেদন করে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন।